Pages

Tuesday, February 28, 2023

শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতাল

ইউরোপীয়দের আসার আগে গ্রামগঞ্জে তখন কবিরাজি চিকিতসাই ভরসা ছিল। শ্রীরামপুরও তখন এই কবিরাজি চিকিতসার ভরসাতেই চলত। এই কবিরাজি চিকিতসকরা থাকতেন কাছেই, যার নাম বৈদ্যবাটি। মুসলিমদের জন্য ছিলো হাকিমী চিকিৎসা। এছাড়া তন্ত্র, যাদু, তাবিজ, কবজ, ঝাড়-ফুক, তুকতাক, জল পোড়া, তেল পোড়া এসবতো ছিলোই। উন্নত বৈজ্ঞানিক  চিকিৎসা পদ্ধতির নাম গন্ধও তখন ছিলো না। দিনেমার সরকার ও শ্রীরামপুর মিশনারীদের হাত ধরেই শ্রীরামপুরে পশ্চিমী অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শুরু হয়।  

১৮৩৪-৩৫ সালে শ্রীরামপুর তথা ফ্রেডরিকনগরের দিনেমার গভর্নর জে. রেখলিং, ডঃ মার্শম্যান ও চিকিৎসক ডঃ ডয়েটের বিশেষ উদ্যোগে এক সভায় শহরের মাননীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এক দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। 

সভায় ১,৪০০ টাকা দান সংগৃহীত হলো এবং ১,৮০০ টাকা বার্ষিক চাঁদা অঙ্গীকৃত হলো। দিনেমার কোম্পানীর গঙ্গাতীরবর্তী পরিত্যক্ত গুদামঘরে ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিকের জন্মদিনে ২৮শে জানুয়ারী ১৮৩৬ সালে শ্রীরামপুরের প্রথম চিকিৎসালয় স্থাপিত হলো। এটি ছিল বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন হাসপাতাল। দিনেমার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিকিৎসক জে. ভোইগট্ ওই চিকিৎসালয়ের প্রথম চিকিৎসক ছিলেন। ঔষধ ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইংরেজ সরকার স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করে। 

১৮৩৮ সালে গুদামঘরটি বিক্রি হয়ে যায়, তখন একটি পুরাতন গৃহ ভাড়া করে চিকিৎসা কেন্দ্রটি চালু রাখা হলো। স্বল্প পরিসর গৃহে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অসুবিধা ঘটতে লাগলে চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থান সংকুলান কি করে বাড়ানো যায় তাই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা হতে লাগলো। দেখা গেল কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত মন্দির লাগোয়া অনেকটা খালি জমিজায়গা পড়ে আছে। জায়গাটিকে কেউ কেউ আখড়াবাটি নাম দিয়েছিলেন। পূর্বে সেখানে দক্ষিণ ভারতের রামানুজ সম্প্রদায়ভুক্ত (মতান্তরে নেপালের ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী সম্প্রদায়ের) বৈষ্ণবদের আখড়া ছিল। ওই অঞ্চলে জঙ্গল পরিষ্কারের সময় একটি পরিত্যক্ত মদনমোহনের বিগ্রহ পাওয়া যায় যা বর্তমানে বল্লভপুরের মদনমোহন মন্দিরে রয়েছে। যাইহোক, পরিত্যক্ত মন্দির সমেত মোট ১২ বিঘা জমি দিনেমার প্রশাসন ক্রয় করে। ১৮৪২ সালে প্রায় এক হাজার টাকা ব্যয় করে সুন্দর একটি নব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। 

দিনেমাররাজ চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য বার্ষিক ৫৩৩ টাকা ৫ আনা ৪ পাই সাহায্য দিতেন যা ১৮৮১ সাল পর্যন্ত চালু রেখেছিলেন। চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থায়ী চিকিৎসক হিসাবে ১৮৪৪ সালে ডাক্তার এ্যাবট যোগদান করার পর চিকিৎসা কেন্দ্রটির প্রভূত প্রসার হলো। ২৫০-৩০০ জন রোগীর থাকবার ব্যবস্থা ছিলো। দিনেমার সরকারের স্থায়ী চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করতেন। দেশীয় সহকারী চিকিৎসক পেতেন মাসিক দশ টাকা। এছাড়াও পুলিশ বিভাগ থেকে কয়েদীদের চিকিৎসার জন্য দেশীয় চিকিৎসক মাসিক ৫ টাকা বেতন পেতেন। ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর নগরী ইংরেজদের অধীনে আসার পর এই হাসপাতালের নাম হয় 'ওয়ালশ হাসপাতাল'। ১৮৭০ সাল থেকে এই হাসপাতালটি শ্রীরামপুর পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত হত। 

পরবর্তীকালে ১৯০৬ সালে গোস্বামী পরিবারের সাহায্যে গোবিন্দসুন্দরী ডিসপেন্সারি চালু হয় - বর্তমানে এটি টিবি হাসপাতাল। গোপীকৃষ্ণ গোস্বামীর পুত্ররা - কিশোরীলাল, নন্দলাল ও অন্যান্যরা ১১,০০০ টাকা ব্যয় করে এই ডিসপেন্সারি এবং দূর থেকে আসা রোগী এবং রোগীর স্বজনদের জন্য প্রতিক্ষালয় তৈরি করে দেন। পরে স্থানীয় মানিকলাল দত্ত মহাশয়ের অর্থসাহায্যে পুরোনো চক্ষু বিভাগের বাড়ি ভেঙ্গে একটি চারতলা বাড়ি নির্মিত হয়।  


স্বাধীনতার পরে এই হাসপাতাল পৌরসভার হাত থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে আসে এবং সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালে পরিণত হয়। ২০১৮ সাল নাগাদ এই হাসপাতালটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে উন্নীত হয়।

https://dailynewsreel.in/186-years-old-walsh-hospital-feature/

No comments: