ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা মজা করে বলে থাকেন - 'স্যার আই এম পুওর' - কালা নেটিভের বলা এই ইংরিজি বাক্য থেকেই নাকি এসেছে শ্রীরামপুরের নাম। যদিও সেটা সত্যি নয়। শেওড়াফুলীর রাজা রাজচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত রাম-সীতার মন্দির থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয় শ্রীরামপুর।
১৭৫৩ সাল (৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১১৬০ বঙ্গাব্দ) নাগাদ মনোহর চন্দ্রের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায় শ্রীপুর গ্রামে বিষ্ণু-অবতার রামচন্দ্রের মন্দির স্থাপন করেন এবং এই মন্দিরের সেবার জন্য শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মনোহরপুর নামক ৩টি মৌজা দেবোত্তর করে দেন। এভাবেই ‘শ্রীপুর’, ‘শ্রীরাম’ ইত্যাদি নাম থেকে ‘শ্রীরামপুর’ নামটির উৎপত্তি।
পরবর্তীকালে আকনা, মাহেশ, বল্লভপুর, চাতরা, মান্নাপাড়া, মল্লিকপাড়া প্রভৃতি মৌজাগুলি এই জনপদের সাথে যুক্ত হয়েছে। ডক্টর হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন, "শ্রীপুর, মোহনপুর ও গোপীনাথপুর নামক তিনটি গ্রাম শ্রীরামচন্দ্র বিগ্রহের সেবায় দেবোত্তর করেছিলেন বলেই গঙ্গাতীরস্থ শ্রীরামপুর তীর্থস্থান।"
মনে রাখতে হবে ড্যানিশ বা দিনেমাররা এই অঞ্চলে (শ্রীপুর, আকনা ও পিয়ারাপুর মহল) এসে কুঠি স্থাপন করে থাকতে শুরু করে ১৭৫৫ নাগাদ। তারও বেশকিছুদিন বাদে দিনেমাররা ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দেয় 'ফ্রেডরিক নগর'। তবে এই নাম শুধু ড্যানিশরাই ব্যবহার করত, স্থানীয়দের কাছে এই জায়গা শ্রীরামপুর বলেই বেশি পরিচিত ছিল। এথেকে পরিষ্কার যে 'শ্রীরামপুর' নামকরণ ফ্রেডরিকনগরের কিছু আগে এবং শ্রীরামপুরের ড্যানিশ/দিনেমারদের বসতি অঞ্চলটুকুই ফ্রেডরিকনগর বলে পরিচিত ছিল।
Entrance of Ram Sita Temple, Serampore |
Ram Sita Temple, Serampore (2020) |
Ram Sita Temple, Serampore (Source: Internet) |
স্থাপত্যের দিক থেকে মন্দিরটি আহামরি কিছু নয়। ত্রিখিলানযুক্ত দালানসহ স্বল্প উচ্চ বেদির উপর নির্মিত ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দিরের চারপাশে সবুজের সমারোহ। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই প্রবেশদ্বার। গর্ভগৃহে একটি কাঠের সিংহাসনে বিরাজ করছে রামচন্দ্র, লক্ষণ, সীতাদেবী ও হনুমানের মূর্তি। মন্দিরের সব বিগ্রহের নিত্যপুজো হয়।
এখানে মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে দেওয়ালে মার্বেল ফলকে লেখা আছেঃ
মন্দিরের বাইরে একটি তুলসীমঞ্চ আছে, তাতে একটি মার্বেল ফলকে লেখা আছেঃ
এখানে রামনবমীতে বড় করে উৎসব পালিত হয়। বর্তমান পুরোহিত চন্দ্রশেখর রায়। ঐতিহাসিক দিক থেকে বলতে গেলে এই মন্দিরের নামেই শ্রীরামপুরের নামকরণ অথচ আজকে শ্রীরামপুর শহরের এককোণে অবহেলায় পড়ে আছে এই মন্দির। মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে বিগ্রহের মাথায়। কদিন আগে পাঁচিলও ভেঙ্গে গেছিল - স্থানীয়দের উদ্যোগে মেরামত হয়েছে সেই পাঁচিল। ওদিকে অযোধ্যায় রামমন্দির হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র। এখন দাবি এই মন্দিরের হেরিটেজ তকমার। হেরিটেজ ফাণ্ড এলে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অনেকটাই সুবিধা হবে।
শ্রীরামপুরের এই রাম-সীতা মন্দিরটি দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হল, বটতলা থেকে দে স্ট্রীট ধরে ৩৫০ মিটার হেঁটে এলে ইউনিক লজের সামনে আসবেন। এই ইউনিক লজের ডানদিকের গলিতে মাত্র ৭৫মিটার হাঁটলেই পাবেন রামসীতা মন্দিরটি। এখন পৌরসভা থেকে এই মন্দিরের গলির সামনে একটি ফলকও লাগানো আছে।
রাম-সীতা মন্দিরের দিগনির্দেশিক ফলক |
No comments:
Post a Comment