Pages

Sunday, February 26, 2023

শ্রীরামপুর পর্ব ৯ঃ রাম-সীতা মন্দির

ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা মজা করে বলে থাকেন - 'স্যার আই এম পুওর' - কালা নেটিভের বলা এই ইংরিজি বাক্য থেকেই নাকি এসেছে শ্রীরামপুরের নাম। যদিও সেটা সত্যি নয়। শেওড়াফুলীর রাজা রাজচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত রাম-সীতার মন্দির থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয় শ্রীরামপুর। 

১৭৫৩ সাল (৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১১৬০ বঙ্গাব্দ) নাগাদ মনোহর চন্দ্রের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায় শ্রীপুর গ্রামে বিষ্ণু-অবতার রামচন্দ্রের মন্দির স্থাপন করেন এবং এই মন্দিরের সেবার জন্য শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মনোহরপুর নামক ৩টি মৌজা দেবোত্তর করে দেন। এভাবেই ‘শ্রীপুর’, ‘শ্রীরাম’ ইত্যাদি নাম থেকে ‘শ্রীরামপুর’ নামটির উৎপত্তি। 

পরবর্তীকালে আকনা, মাহেশ, বল্লভপুর, চাতরা, মান্নাপাড়া, মল্লিকপাড়া প্রভৃতি মৌজাগুলি এই জনপদের সাথে যুক্ত হয়েছে। ডক্টর হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন, "শ্রীপুর, মোহনপুর ও গোপীনাথপুর নামক তিনটি গ্রাম শ্রীরামচন্দ্র বিগ্রহের সেবায় দেবোত্তর করেছিলেন বলেই গঙ্গাতীরস্থ শ্রীরামপুর তীর্থস্থান।" 

মনে রাখতে হবে ড্যানিশ বা দিনেমাররা এই অঞ্চলে (শ্রীপুর, আকনা ও পিয়ারাপুর মহল) এসে কুঠি স্থাপন করে থাকতে শুরু করে ১৭৫৫ নাগাদ। তারও বেশকিছুদিন বাদে দিনেমাররা ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দেয় 'ফ্রেডরিক নগর'। তবে এই নাম শুধু ড্যানিশরাই ব্যবহার করত, স্থানীয়দের কাছে এই জায়গা শ্রীরামপুর বলেই বেশি পরিচিত ছিল। এথেকে পরিষ্কার যে 'শ্রীরামপুর' নামকরণ ফ্রেডরিকনগরের কিছু আগে এবং শ্রীরামপুরের ড্যানিশ/দিনেমারদের বসতি অঞ্চলটুকুই ফ্রেডরিকনগর বলে পরিচিত ছিল। 

Entrance of Ram Sita Temple, Serampore

Ram Sita Temple, Serampore (2020)

Ram Sita Temple, Serampore (Source: Internet) 

স্থাপত্যের দিক থেকে মন্দিরটি আহামরি কিছু নয়। ত্রিখিলানযুক্ত দালানসহ স্বল্প উচ্চ বেদির উপর নির্মিত ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দিরের চারপাশে সবুজের সমারোহ। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই প্রবেশদ্বার। গর্ভগৃহে একটি কাঠের সিংহাসনে বিরাজ করছে রামচন্দ্র, লক্ষণ, সীতাদেবী ও হনুমানের মূর্তি। মন্দিরের সব বিগ্রহের নিত্যপুজো হয়। 

এখানে মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে দেওয়ালে মার্বেল ফলকে লেখা আছেঃ

সাড়াপুলি বা শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পুণ্যহৃদয় 
"ক্ষত্রিয়রাজ" রাজা মনোহর চন্দ্র রায়ের 
পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায় 
শ্রীপুরগ্রামে শ্রীশ্রী  ৺রঘুনাথ ঠাকুর, শ্রীশ্রী  ৺লক্ষ্মণ ঠাকুর, 
শ্রীশ্রী ৺ভরত ঠাকুর, শ্রীশ্রী ৺শত্রুঘ্ন ঠাকুর, শ্রীশ্রী  ৺হনুমানজী, 
শ্রীশ্রী  ৺সীতাদেবী ও শ্রীশ্রী  ৺গোপাল জিউ-এর 
সেবা প্রতিষ্ঠা করেন ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১১৬০ বঙ্গাব্দে (ইং-১৭৫৩) 
উক্ত বিগ্রহের সেবার্থে শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও
মোহনপুর গ্রাম তিনখানি সংযুক্ত করিয়া নাম দেন "শ্রীরামপুর"।
উক্ত বিগ্রহের নিত্যসেবা শেওড়াফুলি রাজ পরিবার
দ্বারা পরিচালিত হয়। 

২০২০ সালে যখন প্রথমবার এসেছিলাম, এই শেষের লাইনটির শুরুর দিকটা সাদা রং করে আংশিক ঢাকা ছিল। ২০২৪ এসে দেখলাম এই শেষ বাক্যটি - 'উক্ত বিগ্রহের নিত্যসেবা শেওড়াফুলি রাজ পরিবার দ্বারা পরিচালিত হয়।' এবং 'শ্রীশ্রী  ৺ ভরত ঠাকুর, শ্রীশ্রী  ৺ শত্রুঘ্ন ঠাকুর' অংশটি সাদা রং করে ঢেকে দেওয়া আছে। এর কারণ জিজ্ঞাসা করার মত লোক পাইনি। মনে হয় ভরত ও শত্রুঘ্ন এর মূর্তিদুটি আর নেই, এবং শেওড়াফুলি রাজা পরিবার থেকে আর্থিক অনুদান এখন বন্ধ আছে। 

আরো একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে মূল গর্ভগৃহের দরজার উপরে একটি সাদা কাগজ সাঁটানো - তাতে লেখা স্থাপিত ১০৭৪ বঙ্গাব্দ ইং ১৬৬৭ সাল। এর থেকে যেটা মনে হয় রাজচন্দ্রের আগেই এই মন্দির ৮৬ বছর আগে স্থাপিত হয়েছিল। রাজচন্দ্র এই মন্দিরের সেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মাত্র।

মন্দিরের বাইরে একটি তুলসীমঞ্চ আছে, তাতে একটি মার্বেল ফলকে লেখা আছেঃ 

শ্রীশ্রী রাম-সীতা মন্দিরের সেবাইত
রাজা নির্ম্মল চন্দ্র ঘোষের 
বংশধরেরা মন্দির
সংস্কার কাজ করলেন।
সাড়াপুলি রাজদেবওর স্টেট(বড় তরফ)
শেওড়াফুলি, রাজবাড়ি
রামনবমী, ১৪১২ 



এখানে রামনবমীতে বড় করে উৎসব পালিত হয়। বর্তমান পুরোহিত চন্দ্রশেখর রায়। ঐতিহাসিক দিক থেকে বলতে গেলে এই মন্দিরের নামেই শ্রীরামপুরের নামকরণ অথচ আজকে শ্রীরামপুর শহরের এককোণে অবহেলায় পড়ে আছে এই মন্দির। মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে বিগ্রহের মাথায়। কদিন আগে পাঁচিলও ভেঙ্গে গেছিল - স্থানীয়দের উদ্যোগে মেরামত হয়েছে সেই পাঁচিল। ওদিকে অযোধ্যায় রামমন্দির হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র। এখন দাবি এই মন্দিরের হেরিটেজ তকমার। হেরিটেজ ফাণ্ড এলে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অনেকটাই সুবিধা হবে।

শ্রীরামপুরের এই রাম-সীতা মন্দিরটি দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হল, বটতলা থেকে দে স্ট্রীট ধরে ৩৫০ মিটার হেঁটে এলে ইউনিক লজের সামনে আসবেন। এই ইউনিক লজের ডানদিকের গলিতে মাত্র ৭৫মিটার হাঁটলেই পাবেন রামসীতা মন্দিরটি। এখন পৌরসভা থেকে এই মন্দিরের গলির সামনে একটি ফলকও লাগানো আছে। 

রাম-সীতা মন্দিরের দিগনির্দেশিক ফলক

No comments: