মাহেশ, বল্লভপুর ঘুরে এবার গন্তব্য শ্রীরামপুরের মূল শহর।
এবার আমাদের গন্তব্য দে স্ট্রীট। প্রথমেই যাব দে বাড়িতে। ঠাকুরদালান সম্বলিত এই বাড়ি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো আর এখানকার দূর্গাপুজোও খুব বিখ্যাত। হুগলি জেলার বনেদী বাড়ির পুজোর লিস্ট করতে বসলে দে বাড়ির পুজোকে বাদ দেওয়া যাবে না। কাছেই দে ঘাট - দে পরিবার নিজেদের জন্য বানালেও এখন সবার জন্যই খোলা। এই ঘাটে এখন বেশ কিছু ছোট মন্দির দেখতে পাওয়া যায় - করুণাময়ী কালীমাতা, চৌরঙ্গী বাবা এবং দূর্গামাতার মন্দির।
দে বাড়িকে অনেকেই জমিদারবাড়ি বলে ভুল করে, কিন্তু এঁনারা ছিলেন মূলত কলকাতার বড়বাজারের লবণ ব্যবসায়ী। ১৭৮০ এর দশকে ব্যবসা করেই এঁরা শ্রীরামপুরের অন্যতম ধনী পরিবার হয়ে ওঠেন। ১৭৪৮ সালে (বা ১৭৫০ সাল) দে পরিবারের দুর্গাপুজোর শুরু হয় রামভদ্র দে-র হাত ধরে।
পরবর্তীকালে রামচন্দ্র দে এবং তাঁর ছেলে কর্মবীর রাজকৃষ্ণ দের আমলে দে পরিবারে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হয় এবং সাথে সাথে দে বাড়িতে দুর্গাপূজার জৌলুশও বাড়তে থাকে। সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। এই পরিবারের লোকজন পরে হাওড়া, হুগলী এবং কলকাতাতে ছড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুজোর ক'দিন এই পৈতৃক বাড়িতে সবাই আসেন মনের টানে, মায়ের টানে। একচালার সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা দেখতে আসেন বাইরে থেকে বহু মানুষ। দালানে বিভিন্ন রকম সাংকৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। দে বাড়ির পুজোদালানে কালীপুজোও হয়।
দে'দের কুলদেবতা হলেন শ্রীধর জিউ - তার নিত্যপূজা হয়। দে'দের দুর্গাপূজার শুরু হয় তাই বৈষ্ণব ধর্মমতে, এবং এই পুজোতে কোনরকম বলি হয় না। রাস উৎসবও জাঁকজমকসহ পালিত হয়।
আগেই বলেছি এই পরিবারের জনসংখ্যা ছিল অনেক, ফলে বাড়িটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে আরো বাড়ানো হয়। অনেকাংশেই দে বাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ - ইট বেরিয়ে পড়েছে, গাছ গজিয়েছে দেওয়াল বেয়ে। এই বাড়ির একাংশে ১৯৩৬ সালে 'শ্রীরামপুর ভারতী বালিকা বিদ্যালয়' এবং ভারতী বালিকা প্রাইমারী স্কুল শুরু হয়। আরো এগিয়ে এলে দেখতে পাবেন অন্নদা স্মৃতি ভবন (১৩৪১ বঙ্গাব্দ)।
|
দে বাড়ি - মূল ফটক |
|
ঠাকুরদালান - দে বাড়ী, শ্রীরামপুর |
|
দে বাড়ি |
|
দে বাড়ীর বর্ধিত অংশ |
|
দে বাড়ীর অংশ বিশেষ |
|
দে বাড়ীর অংশ বিশেষ
|
ব্যবসায়ী হলেও দে-বাড়িতে পড়াশুনোর বেশ চল ছিল। সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁরা শ্রীরামপুর কলেজের জন্য কিছু জমি দান করেছিলেন। শহরের বিভিন্ন কাজেও তাঁরা দানধ্যান করতেন।
দে পরিবারের শ্রীনাথ চন্দ্র দে একটি প্রেস চালু করেছিলেন - তার নাম ছিল তমোহর প্রেস। এখান (তমোহর যন্ত্র) থেকে বেশ কিছু বইপত্র ছাপা হয়েছিল - যেমন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পরিচয়, বাষ্পীয় কল এবং ভারতবর্ষীয় রেলওয়ে, বংশবলী গ্রন্থ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত তমোহর শব্দের অর্থ অজ্ঞানতা নাশক। এখান থেকে একসময় একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাগাজিনও ছাপা হত - নাম ছিল বিজ্ঞানমিহিরোদয়।
প্রথমে এই পত্রিকা মাসিক ছিল, দ্বিতীয় বছর থেকে পত্রিকাটি পাক্ষিক আকার ধারণ করে। প্রথম প্রকাশকাল ২-রা বৈশাখ, ১২৬৪ বঙ্গাব্দ (১৩ই এপ্রিল, ১৮৫৭)। আট পৃষ্ঠার পত্রিকাটির দাম ছিল দুই আনা, এবং বার্ষিক ১২-সংখ্যার দাম ছিল ১ টাকা। এর সম্পাদক ছিলেন “কলিকৌতুক নাটক"-রচয়িতা শ্রীনারায়ণ চট্টরাজ গুণনিধি। "বিজ্ঞানমিহিরোদয়’ পত্রের কণ্ঠে নিম্নোদ্ধত শ্লোকটি লেখা থাকত —
পুঞ্চন্নেষ প্রতিক্ষণং খলু হরিশ্চন্দ্রং নিজেরশ্মিভিভিন্ন সান্দ্রতমাংসি দুষ্কৃতধিয়ামৰ্থান সমুদ্দীপয়ন । খ্ৰীনারায়ণপুৰ্ব্বশৈলশিখরাদুগুন কজাংস্তেষয়ন্ স্বদ্বিজ্ঞানখিলোচলোহি মিহির: শ্ৰীমান্নভঃক্রামতি ॥
প্রত্যেক সংখ্যার শেষে এই অংশটি মুদ্রিত থাকত :
যে মহাশয়েরা এই পত্র গ্রহণাভিলাষী হইবেন তাঁহারা সহর শ্রীরামপুরে শ্রীযুত বাবু হরিশ্চন্দ্র দে চতুর্ধুরীণ মহোদয়ের নিকট পত্র প্রেরণ করিলে প্রাপ্ত হইতে পারিবেন । ইহার মাসিক মূল্য (৴) দুই আনা! ও বার্ষিক অগ্রিম মূল্য ( ১৲) এক টাকা মাত্র । শ্রীশ্রীনারায়ণ চট্টরাজ গুণনিধি। সম্পাদক ।
বিজ্ঞানমিহিরোদয়-এ কিরকমের লেখা প্রকাশিত হত, তার একটা আভাস দেওয়ার জন্য পত্রিকার
দ্বিতীয় সংখ্যায় (২ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৪) প্রবন্ধগুলির নাম দেওয়া হলঃ
১। বিজ্ঞানমিহিরোদয়। ২। মনস্তত্ত্ববিদ্যা, ৩। মহাবীর আলেকজান্দর বাদসাহের জীবন চরিত্র, ৪। অধ্যাত্মবিদ্যা ৫।দরিদ্রের মনোরাজ্য, ৬। শৈশব চরিত্র কাব্য, ৭। খ্রীষ্টধর্ম্মxxx, ৮। মাসিক সন্দেশাবলি।
বিজ্ঞানমিহিরোদয়ের প্রথম পাক্ষিক সংখ্যায় মুদ্রিত সম্পাদকীয় বিজ্ঞাপনে প্রকাশঃ
“... আমরা যেরূপ সময় ও শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য বিসর্জ্জন দিয়া দেশোপকারি ব্রত অবলম্বন করিয়াছি, আমাদিগের গ্রাহক মহোদয়গণও সেইরূপ দেশহিতৈধিতা-গুণ-ভাজন হইয়া যৎকিঞ্চিৎ অর্থ বিতরণ আনুকূল্যে তদুদযাপনে উৎসাহপরায়ণ হইয়াছেন । কিন্ত আমাদিগের যে সকল বিষয়ে লেখনী পরিচালনের অভিপ্রায় আছে, তাহা সমুদায় এই ক্ষুত্রকায় পত্রে সুসিদ্ধ হওয়া সাধ্য হয় না, এজন্য আমরা অসামান্য গুণসম্পন্ন গণ্য মান্য গ্রাহকগণের করুণা-বিতরণে কার্পণ্য প্রকটন্ সম্ভাবনা না করিয়া প্রতি মাসে বারদ্বয় মিহিরোদয়ের প্রকাশে প্রযত্ব ধারণ করিয়াছি বোধ করি ইহাতে তাঁহাদিগের মাসিক দাতব্য পণ্যের যে দৈগুণ্য হইবে তজ্জন্য তাঁহারা কেহই কাতর হইবেন না । এবং তাহাতে অস্মদাদিকে স্বাভিলাষ অসিদ্ধ জন্য অনুৎসাহ বাণে এতাদৃক্ বিদ্ধ হইতে হইবে না। সময়ে প্রতিজ্ঞাত বিষয় সকল ও বিশেষতঃ সংস্কৃত গ্রন্থোক্ত শাস্ত্রীয় বিবরণ সকল বঙ্গভাষাষ অনুবাদিত হইয়া দেশেব উপকারার্থ এতৎপত্রে প্রকটিত হইবে।
শ্রীরামপুরের ব্রজখোলায় ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হরিশচন্দ্র দে। হরিশচন্দ্র দে'র পরবর্তীকালে দে পরিবারে অর্থনৈতিক ভাঙ্গন ধরে। ব্রিটিশের হাতে শ্রীরামপুর আসার পর দে-পরিবারের চাঁকচমক আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.kolkata24x7.com/dey-bari-puja-of-serampore/
https://www.facebook.com/deybari.serampo
https://sumantachatton.blogspot.com/2019/10/blog-post.html
Google Maps - Dey Bari Review
বাংলা সাময়িক পত্রিকা - চতুর্থ পরিচ্ছেদ ১৮৪০-১৮৫৭
No comments:
Post a Comment