Pages

Tuesday, February 21, 2023

শ্রীরামপুর পর্ব ৭ঃ শ্রীরামপুর কলেজ এবং কেরী মিউজিয়াম, পঞ্চানন কর্মকার, চটকল, শ্রীরামপুর জননগর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং টেক্সটাইল কলেজ

এরপর চলে আসি শ্রীরামপুর কলেজ এবং কেরি মিউজিয়ামে। 

ভারতে উইলিয়াম কেরি (১৭ আগস্ট ১৭৬১  - ৯ জুন ১৮৩৪) এসেছিলেন মূলত ক্রিশ্চান ধর্ম প্রচার করতে, কিন্তু তাঁর কাজ ধর্ম প্রচারের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজ সংস্কারের পথ দেখিয়েছিল। মার্শম্যান এবং ওয়ার্ডের সহায়তায় কেরি শুধু কলেজই শুরু করেননি, তার সাথে সাথে করেছেন অসংখ্য বইএর অনুবাদ - বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়। তার প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপা হত সমাচার দর্পণ, দিগদর্শন এবং ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া - এই পত্রিকাগুলোকে আজকের স্টেটসম্যান এর দাদু-ঠাকুরদা বলাই যায়। বাংলায় বাইবেল অনুবাদ ছাড়াও কেরী বহু বই সংস্কৃত ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। সত্যি কথা বলতে গেলে বাংলার জন্য কেরী সাহেবের অবিস্মরণীয় কীর্তিকলাপ এই ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। 

১৭৯২ সালে ইংল্যাণ্ডের ডিডকট শহরে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটি স্থাপিত হয়। এই সোসাইটির উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার শুরু হয়। মূলত এই উদ্দ্যেশ্যেই ১৭৯৩ সালের ১৩ জুন নরদাম্পটনের উইলিয়াম কেরী তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ফিলিক্স, স্ত্রী ও কন্যাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ১১ নভেম্বর তিনি ও তার সহযাত্রীগণ কলকাতায় পৌঁছান। তার পর থেকে কেরী ভারতীয় ভাষাগুলি শিখতে মগ্ন হয়ে পরেন এবং বাংলায় বাইবেল অনুবাদও করে ফেলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ সরকার খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারের কাজে যুক্ত মিশনারীদের কাজে বিরক্ত হন এবং তাদের কাজে বাধা তৈরি করেন। 

"Expect great things from God
Attempt great things for God
"
- William Carey 

১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে কলকাতা আসেন চার মিশনারী উইলিয়াম ওয়ার্ড, ডেভিড ব্রুনস্‌ডন, জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম গ্র্যান্ড। এদের মধ্যে মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতার অদূরে ডেনিশ মিশন শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি কেরি এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তৈরি হয় শ্রীরামপুর মিশন বা শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন 

অল্ডিন হাউসে মাত্র ৩৭ জন ছাত্র নিয়ে ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজের প্রথম ক্লাস শুরু হয়। তিন বছর পরে ১৮২১ সালে আজকের শ্রীরামপুর কলেজ ক্যাম্পাসে কলেজটি উঠে আসে। উইলিয়ম কেরি, জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়ম ওয়ার্ড ছিলেন এশিয়ার দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরোনো কলেজের মূল উদ্যোক্তা (এশিয়ার প্রাচীনতম কলেজ ১৬১১ সালে শুরু হওয়া ফিলিপিন্সের ইউনিভার্সিটি অফ সান্টো থমাস)। সেই দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই শ্রীরামপুর কলেজ (১৮১৮)।(Website: https://www.seramporecollege.org/ ) ১৮২৭ সালে ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিকের দেওয়া সনদ (Royal Charter)-বলে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায় এবং ডিগ্রী প্রদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়। এটি হচ্ছে সর্বপ্রথম এবং এখন পর্যন্ত ভারতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ধর্ম, মানবিক বিদ্যা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় একই সঙ্গে পড়ানো হয়। 

প্রসঙ্গত ভারতের অন্যান্য পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় গুলি হল রুরকি বিশ্ববিদ্যালয় এবং থমাসন কলেজ অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (১৮৪৭) (আজকের আই আই টি রুরকি), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (জানুয়ারি ১৮৫৭), বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় (জুলাই, ১৮৫৭) এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় (সেপ্টেম্বর ১৮৫৭)। যদিও বাংলা তথা কলকাতার প্রথম কলেজ হিন্দু কলেজ (স্থাঃ ১৮১৭), পরে যা পরিবর্তিত হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ (১৮৫৫)। প্রেসিডেন্সি কলেজ ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মান্যতা পায়।  

শ্রীরামপুর কলেজের গ্রন্থাগার তথা কেরী লাইব্রেরী ও রিসার্চ সেন্টারের আর্কাইভে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রায় ১০১টি ভাষায় দশ হাজারেরও বেশি পুরোনো বই রয়েছে। এই গ্রন্থাগার এবং রিসার্চ সেণ্টার ২০০ বছরের ইতিহাস ধরে রেখেছে। ১৯৯৩ সালে নরওয়ে এবং ডেনমার্ক সরকারের অর্থনৈতিক সাহায্যে একটি নতুন ভবন স্থাপিত হয়। 

Desk used by William Carey at Carey Museum (Source: Internet)

আজকে গঙ্গার ধারে শ্রীরামপুর কলেজের লোহার মূল দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে দেখা যায় সাদা রঙের মূল ভবন - সামনে দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। ভবনের উঁচু ছাদ, কড়ি-বর্গা, খড়খড়ি দেওয়া জানলা, মস্ত খিলান, গম্বুজ - নিয়ে যায় ২০০ বছরের আগের দিনগুলিতে। 

এই কলেজ নজর কেড়েছে অনেকবারই। ১৯৬৯ সালে কলেজের পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে ভারতীয় পোস্ট। ২০২২ সালে শ্রীরামপুরের কলেজের মূল ভবনটি হেরিটেজ তকমা পায়। 



উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণের পিছনে ছিলেন এই উইলিয়াম কেরী এবং তাঁর 'মিশন প্রেস'। বাংলা হরফে ছাপা বইএর কথা যখন কেউ ভাবতেও পারেননি, সেই সময় রেভারেণ্ড কেরী শ্রীরামপুরে নিয়ে আসেন উডনী সাহেবের থেকে উপহার প্রাপ্ত মুদ্রণযন্ত্র। ১৮০০ সালের মার্চ মাসে গাছের ছাল থেকে বাংলা হরফ প্রস্তুত করে এই ছাপাখানা বাংলা বই ছাপাতে শুরু করে। কেরীর উদ্যোগে এই মিশন প্রেস শুরু হলেও এর মূল দায়িত্বে ছিলেন ওয়ার্ড সাহেব। এ প্রসঙ্গে একজনের কথা না বললে শ্রীরামপুরের ইতিহাস পূর্ণ হয় না, তিনি হলেন পঞ্চানন কর্মকার

এর আগে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে গোড়াতে কেরি মালদহের কাছে মদনাবতী অঞ্চলের খিদিরপুরে একটা ছাপার যন্ত্র বসিয়ে বিচল হরফ দিয়ে বাংলায় বই ছাপার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু খরচের বহর দেখে পিছিয়ে আসেন। ১৭৯৫ সাল নাগাদ, বিলেতে খবর নিয়ে জানলেন, বাংলার এক একটা হরফ ঢালাই করতে খরচ পড়বে ১৮ শিলিং করে। বই ছাপতে গেলে যে ছ’শো ছেনি হরফ দরকার, তা বিলেত থেকে তৈরি করিয়ে এবং দশ হাজার বই ছাপিয়ে আনতে খরচ পড়বে অন্তত ৪৩৭৫০ টাকা! কিন্তু মিশন চালু হওয়ার পর বাংলায় খ্রীষ্টধর্ম বিষয়ক বই না হলে বাঙ্গালীর কাছে পৌঁছাবেন কি করে? 

বাংলায় মুদ্রণাক্ষরের জনক পঞ্চানন কর্মকারের জন্ম ১৭৫০ সালে, তৎকালীন বাংলার হুগলি জেলার ত্রিবেণী গ্রামে। পিতা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শম্ভুচরণ কর্মকার। পঞ্চাননের পূর্বপুরুষরা ছিলেন লিপিকার, ধাতু অলঙ্কারক, দক্ষ খোদাইকারক। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল হুগলি জেলার বলাগড়-জিরাটে, পরে তাঁরা ত্রিবেণীতে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তাঁদের পদবী ছিল মল্লিক। তাঁদের পরিবারের সুদক্ষ শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্বয়ং নবাব আলীবর্দী খাঁ। একসময়ে তাঁরা লোহা দিয়ে বহু কাজকর্ম শুরু করেন এবং নামের সাথে জুড়ে যায় কর্মকার পদবী। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে দুই ছেলে পঞ্চানন আর গদাধরকে নিয়ে জিরাট থেকে বংশবাটি (আজকের বাঁশবেড়িয়া) চলে এলেন শম্ভুচরণ কর্মকার। কারণটা ঠিক জানা যায় না, হতে পারে ছিয়াত্তরের ভয়ংকর মন্বন্তর, কিংবা ক্রমাগত জলদস্যুদের আক্রমণ এবং লুঠতরাজ। সময়ের সাথে স্বাভাবিকভাবেই উত্তরাধিকারসূত্রে পঞ্চানন হয়ে ওঠেন ত্রিবেণীর দক্ষ ধাতুশিল্পী। 

হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে যে ১৫৫৬ সালেই ভারতে প্রথম ছাপাখানা আসে পর্তুগীজদের হাত ধরে গোয়াতে। পরে ইংরেজ মিশনারীদের চেষ্টায় সারা ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হয়। আর বাংলায় প্রথম ছাপাখানা শুরু হয় হুগলীতে ১৭৭৮ সালে, ফাদার অ্যাণ্ডুজ ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা।অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইংরেজরা নিজেদের দরকারেই বাংলা ভাষাশিক্ষাতে আগ্রহ দেখায় - এতে শাসনকার্যেও সুবিধা হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার ও আধুনিক ছাঁচের ফরাসি হরফের স্রষ্টা চার্লস উইলকিন্স (Charles Wilkins) সাথে নিলেন পঞ্চানন কর্মকারকে। ছেনি দিয়ে পাথর কেটে ঢালাই ফেলে পঞ্চানন তৈরি করলেন মুভেবেল ফন্ট বা বিচল ধাতব বাংলা হরফ। পঞ্চানন কর্মকার হয়ে উঠলেন “ বাংলার ক্যাসটন” বা “বাংলার মুদ্রণ শিল্পের জনক ”।  এই হরফের ব্যবহারে হুগলীর চুঁচুড়াতে ১৭৭৮ সালে চার্লস উইলকিন্স ছাপা শুরু করলেন হ্যালহেডের (Nathaniel Brassey Halhed) প্রথম বাংলা হরফের ব্যাকরণ বইটি। হেস্টিংসের সহস্রমুদ্রা সাহায্যপ্রাপ্তির উৎসাহ যদিও ছিল মূল কারণ। 

প্রকাশের পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রশংসিত এবং পুরস্কৃতও হয় ‘A Grammar of the Bengal Language’ নামের বইটি, অথচ বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে উপেক্ষিত-ই থেকে যান উইলকিন্সের সাহায্যকারী প্রথম বাঙালি হরফ-খোদকার পঞ্চানন কর্মকারের নাম। 

এর পরে কলকাতায় ১৭৭৯ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের ঐকান্তিক উৎসাহে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দ্বিতীয় ছাপাখানাটি শুরু করলে উইলকিন্স-পঞ্চাননই তার মূল দায়িত্ব নেন এবং পঞ্চাননের উদ্যোগেই এখানে একটি হরফ ঢালাইখানাও তৈরি হয়েছিল। এই কোম্পানির ছাপাখানা থেকেই ভারতের প্রথম সংবাদপত্র হিকির গেজেটের প্রথম দশটি সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল। আর এই প্রেসে পঞ্চাননের তৈরি হরফেই একে-একে প্রকাশিত হচ্ছিল জোনাথন ডানকান, জি সি মেয়ার, এন বি এডমন্ডস্টোন-এর আইন-আদালত সম্পর্কিত পুস্তিকাগুলি। ১৭৮৫ সালে এখান থেকে প্রকাশিত হয় হেস্টিংসের বহু প্রতীক্ষিত 'শ্রীমদ্ভগবদগীতা'র প্রথম ইংরেজি অনুবাদ, যার ভূমিকা রচনা লিখেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস নিজে। ১৭৮৬ সালে উইলকিন্স দেশে ফিরে গেলে পঞ্চাননও কোম্পানির প্রেস ছাড়েন এবং সংস্কৃতজ্ঞ সিভিলিয়ান এইচ টি কোলব্রুক-এর কাছে কাজ শুরু করেন।  

এদিকে শ্রীরামপুরে বসে পঞ্চাননের খবর পেলেন উইলিয়ম কেরী। কোলব্রুকের কাছে আবেদন করলেন যে পঞ্চানন কর্মকারকে শ্রীরামপুরের মিশন প্রেসের দরকার। কিন্তু কোলব্রুক রাজি হননি। তখন কেরী সাহেব পঞ্চানন কর্মকারকেই সোজাসুজি চিঠি লিখলেন, তারও কোন উত্তর মিলল না। শেষমেষ কেরী সাহেব ক'দিনের জন্য পঞ্চানন কর্মকারকে ধার চাইলেন কোলব্রুক সাহেবের কাছে। এবার আর না করতে পারলেন না কোলব্রুক সাহেব, পঞ্চানন রওনা দিলেন শ্রীরামপুর - শ্রীপান্থ তাঁর 'যখন ছাপাখানা এলো' বইটিতে যাকে বলেছেন 'অগস্ত্য যাত্রা'। ভাবতে অবাক লাগে যে আজ থেকে প্রায় ২২৫ বছর আগে এক নেটিভ বাঙালী কর্মচারীকে নিয়ে হয়েছিল দুই সাহেবের দড়ি টানাটানি।

যাই হোক কেরী আর পঞ্চাননের দেখা হল, পঞ্চানন হরফ পিছু দর দিলেন এক টাকা চার আনা। বিলেতে বাংলায় বাইবেল ছাপার থেকে অনেক কম দাম - কেরী সাহেব যেন হাতে চাঁদ পেলেন। ১৮০০ সাল নাগাদ 'বাঙ্গালীর বিশ্বকর্মা' পঞ্চানন যোগ দিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে। কদিন পর তাঁর সাথে যোগ দিলেন জামাই মনোহর এবং মনোহর-পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র। সীসা দিয়ে বাংলা অক্ষর তৈরি হল। ১৮০১ সালে কেরির অনুদিত বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট বাংলায় ছাপা হল পঞ্চাননের তৈরি হরফে। এক হাজারে খরচ পড়ল ১৬ হাজার টাকা। তা ছাড়াও ‘হিতোপদেশ’ এবং ‘কথোপকথন’ নামে দু’টি বইও ছাপা হল। মিশনারি সাহেবদের চেষ্টায় রামায়ণ, মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হল। ১৮০৩ সালে ভারতের বুকে প্রথম দেবনাগরী হরফ প্রস্তুত করেন পঞ্চানন, উইলকিন্সের সংস্কৃত ব্যাকরণের জন্য। এরপর আরবি, ফারসি, মারাঠি, বর্মী, গুরুমুখী, তেলেগু সহ মোট চোদ্দোটি ভাষার মুদ্রণযোগ্য হরফ তৈরি করেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। ১৮০৯ সালে প্রেসের নিজের বাষ্পচালিত কাগজকলও শুরু হয়।  

কেরি এবং অন্য মিশনারীরা মিলে ১৮১৮ সাল থেকে ইংরেজি একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন - ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া (The Friend of India), ১৮৭৫ অবধি এই পত্রিকা প্রকাশিত হত। ১৮৯৭ সালে ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া মিশে যায় স্টেটসম্যান পত্রিকার সাথে। 

১৮১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে প্রকাশিত মিশন প্রেসের 'দিগ-দর্শন' ছিল একটি মাসিক পত্রিকা - বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। বস্তুতপক্ষে ভারতীয় সাংবাদিকতার শুরুও এই পত্রিকা থেকে।১৮১৮ সালের ২৩শে মে প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক 'সমাচার দর্পণ' (Samacara Darpana), যা ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দ্বিতীয় পত্রিকা এবং বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা। মার্শম্যান ছিলেন সম্পাদক কিন্তু মূল দায়িত্ব ছিল শ্রীরামপুর মিশনের তারিণীচরণ শিরোমণির উপর। ১৮৩২ এবং ১৮৩৪ এর মধ্যে কিছুদিন দ্বি-সাপ্তাহিক ছিল। ১৮৪০ অবধি মিশন প্রেস থেকেই এটি প্রকাশিত হত, তারপর ১৮৪২ সালে ভগবতীচরণ চট্টোপাধ্যায় আবার সমাচার দর্পণ প্রকাশ শুরু করেন। ১৮৫১ সালে মিশন প্রেস আবার এই পত্রিকার দায়িত্ব নেয়, কিন্তু দুই বছরের বেশি আর চালাতে পারেনি - ১৮৫৩ সালে সমাচার দর্পণের শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। 

মিশন প্রেস থেকেই ছাপা হত ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটির সব বই। শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ছাপা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত বাইবেল ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে, এমনকী বিদেশেও। ঐতিহাসিকদের মতে সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রেস ছিল এই মিশন প্রেস। ১৮০৪ সালে পঞ্চানন কর্মকার মারা যান। কিন্তু তাঁর কাজ থামেনি। 

১৮১২ সালে আগুনে ছাই হয়ে যায় জমজমাট মিশন প্রেস আর পঞ্চাননের তৈরি করা ফন্ট - আনুমানিক ৭০ হাজার টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়। কিন্তু মনোহর আর সহকর্মীরা পঞ্চাননের তৈরি ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষার ফন্টগুলি পুনরুদ্ধার করেন। মনোহর ও তাঁর সহযোগীরা এরপরে ফার্শি আরবি সহ পনেরোটি ভারতীয় ভাষার হরফ তৈরি করে দেন। শুধু চিনা ভাষায় হরফ খোদাই করে দেন চল্লিশ হাজার! ১৮১৮ থেকে ১৮২২ পর্যন্ত সেখান থেকে বিভিন্ন ভাষায় বারোটি বইয়ের পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপা হয়। ১৮০১ থেকে ১৮৩১ এর মধ্যে মিশন প্রেস প্রায় ৪০টি ভাষায় ২ লাখ ১২ হাজার বই ছাপিয়েছিল। 

১৮৩৭ সালে দেনার দায়ে মিশন প্রেসের কাজ অনেকটা কমে আসে এবং কলকাতার মিশন প্রেসের সাথে মিশে যায়, যদিও পত্রিকা ছাপার কাজ চলত। ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর ইংরেজের হাতে এলে প্রেস প্রায় বন্ধই হয়ে যায়, শেষমেষ ঝাঁপ ফেলে ১৮৫৫-এ। এই মিশন প্রেসটি সম্ভবত শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর-ত্রয়ীর প্রথম বাসস্থান শ্রীরামপুর-জননগর ব্যাপ্টিস্ট চার্চের পিছনে এবং পরে আজকে যেখানে শ্রীরামপুর চটকল সেখানে। আজ সেই ছাপাখানার কোনও চিহ্ন পাওয়ার কথাও না, কিন্তু কোথায় সেটি ছিল, তার কোনও স্থান নির্দেশক ফলকও কোথাও নেই।

প্রসঙ্গত ১৮১৮ সালে কলকাতায় ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসের কাজ শুরু হয়। অক্সফোর্ডের Clarendon Press-এ শিক্ষিত W. H. Pearce এর দায়িত্ব নেন। এরও আগে কেরী সাহেব কলকাতার বউবাজারে ১৮০৯ সালে স্থাপন করেন কলকাতার প্রথম ব্যাপ্টিস্ট চার্চ - যা আজ কেরী ব্যাপ্টিস্ট চার্চ নামে পরিচিত। ১৮৩৭ সালে শ্রীরামপুর এবং কলকাতার মিশন প্রেস একসাথে মিশে যায় এবং মূল কর্মকাণ্ড কলকাতাতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭০ সাল অবধি এই প্রেসের কাজ চলত, এরপর ইলিয়ট রোড এবং লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলের এই জমি বিক্রি হয়ে যায়। আজ আর তার কোন চিহ্ন নেই। 

শ্রীরামপুরের বটতলাতেই ১৮৩৮/৩৯ সালে মনোহর-কৃষ্ণচন্দ্র একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৬/৪৭-এ মনোহর মারা যাওয়ার পরে কৃষ্ণচন্দ্র ছাপাখানাটির অনেক উন্নতির চেষ্টাও করেছিলেন। পঞ্জিকার ছবি নিজেই আঁকতেন, ব্লকও নিজেই তৈরি করতেন। ১৮৫০ সালে কলেরায় 'কৃষ্ণ মিস্ত্রি' অকালে পরলোক গমন করেন। এরপর কৃষ্ণচন্দ্রের দুই ভাই রামচন্দ্র ও হরচন্দ্র ‘অধর টাইপ ফাউন্ড্রি’ নামে এক হরফ তৈরির কারখানা খোলেন। বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’ ছাপার সময়ে ওই ফাউন্ড্রি থেকেই তৈরি করিয়েছিলেন বর্ণপরিচয়ের অক্ষর। ১৮৫৫ সালের ভরা বৈশাখে এপ্রিলের ১৩ তারিখ প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ। ওই বছরের ১৪ জুন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় ভাগ। এই ফাউন্ড্রি ১৯৯৭ সাল অবধি সচল ছিল। 

দুঃখের বিষয় বাংলার ইতিহাস পঞ্চানন কর্মকারকে সেভাবে মনে রাখেনি। শ্রীরামপুরে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করলে কেউ ওঁনাকে চিনবে না। ওঁনার বাড়ি ভেঙ্গে বহুতলও উঠেছে অনেকদিন হল। বটতলার কাছে নিউ গেট ষ্ট্রীটে পঞ্চানন সিঙ্গির বাড়ীর উল্টোদিকে একটি ফ্ল্যাট বাড়ি দেখতে পাবেন - ওটিই ছিল পঞ্চানন কর্মকারের বাড়ি। তবে একটি ইউটিউব ভিডিও থেকে জানা যাচ্ছে যে পঞ্চাননবাবুর বর্তমান উত্তরপুরুষ, বিমান মল্লিক বটতলার কাছে কোম্পানি পুকুর এরিয়াতে এখনো থাকেন। 

ইদানিং কিছু চেষ্টা চলছে পঞ্চাননবাবুর সাথে আজকের মানুষজনকে পরিচয় করানোর - অনীক গ্রুপের 'আক্ষরিক' নাটক (https://www.thirdbell.in/events/akhorik/), সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের বই 'হরফশিল্পের পুরোধা পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর পরিবার', রজত চক্রবর্তীর বই ‘পঞ্চাননের হরফ’ (প্রকাশক: পার্চমেন্ট) ইত্যাদি। 

আক্ষরিক - পোস্টার 

শ্রীরামপুর জুট মিল/চটকল 

শ্রীরামপুর কলেজের ঠিক উত্তরে ছিল এক সময়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস - আজ সেখানে গড়ে উঠেছে ইণ্ডিয়া জুট মিল। ১৮৬৬ সালে স্থাপিত এই পাটকলটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন পাটকল (প্রসঙ্গত ভারতের প্রথম পাটকল অকল্যাণ্ড পাট কল (১৮৫৫, রিষড়া))। আর্থিক সমস্যা, কাঁচামালের অভাব এবং লোকসানের কারণে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই জুটমিলটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২১ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এটি মুরলীধর রতনলাল এক্সপোর্ট লিমিটেডের অধীনে৷ অজয় কাজারিয়া এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এদের অধীনে এখন হাওড়া এবং হুগলীর বেশ কিছু পাট কল আছে। 


শ্রীরামপুর জননগর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ

শ্রীরামপুর কলেজ ছাড়িয়ে একটু উত্তরে হাঁটলে চটকল ছাড়িয়ে গেলে ৭ং উইলিয়ম কেরী রোডে দেখতে পাব - শ্রীরামপুর জননগর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ যা ছিল শ্রীরামপুর ত্রয়ী - কেরি, ওয়ার্ড এবং মার্শম্যানের প্রথম বাসগৃহ। 

চার্চের মূল দরজা 

Serampore Johnnagar Church - Prayer Timings

Main Building of Serampore Johnnagar Church

Inside of Serampore Johnnagar Church

Inside of Serampore Johnnagar Church

শ্রীরামপুরে আসার পর এই তিনজন মিলে তৎকালীন গর্ভনরের ভাগ্নের থেকে এই জমিটি কেনেন গঙ্গার ধারে। সেই সময় দাম পড়েছিল ৬০০০ টাকা, তার অর্ধেক নিজেদের পকেট থেকেই গেছিল, বাকিটা এসেছিল ইংল্যাণ্ড থেকে আনা টাকা, আর কিছুটা ধার নিয়ে। এখানেই স্থাপিত হয় পুরোনো মিশন চ্যাপেল আর এখানেই থাকতেন শ্রীরামপুর ত্রয়ী এবং তাঁদের সহায়ক জন ম্যাক। ১৮০০ সালের শেষে এঁদের হাতেই প্রথম হিন্দু, জাতিতে ছুতোর কৃষ্ণ পাল খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।

মূল ভবনটির পাশে প্রথম স্থাপিত হয় কেরীর মিশন প্রেস, এবং  পিছনের পাঁচ একর বাগানে চলত কেরীর উদ্ভিদ চর্চা। কেরীর এই প্রাইভেট বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছিল বিশাল এক পাখির খাঁচা, জলজ উদ্ভিদদের জন্য চারটি বিশাল পুকুর এবং সামান্য ঘাস থেকে শুরু করে মেহগনির মত গাছ। এই সূত্রেই কেরীর সাথে আলাপ হয় ক্যালকাটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রধান এবং বোটানির কিংবদন্তি উইলিয়ম রক্সবুর্গ (William Roxburgh) এর সাথে। এই বন্ধুত্বের সূত্রেই রক্সবুর্গ শালগাছের নাম রাখেন Careya saulea, যদিও পরে শালের নাম হয় Shorea robusta। শেষমেষ কুম্ভীগাছের নাম রাখেন Careya arborea। ১৮২০ সালে কেরী কলকাতার আলিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন Agricultural and Horticultural Society of India।  


মূল ভবনের উত্তরে ছিল কাগজ কল - তৈরি হত মার্শম্যানের উদ্ভাবিত ফর্মুলায় শ্রীরামপুর পেপার, যাতে সাদা পিঁপড়ে এই কাগজ নষ্ট না করতে পারে। 

১৮২১ সালে জননগরে আরেকটি চার্চ স্থাপিত হয় মূলত জন ক্লার্ক মার্শম্যানের উদ্যোগে। দুটি চার্চ প্রায় একই রকম ভাবে চালিত হলেও ভাষা ছিল আলাদা। জননগরে বাংলায় এবং এই মিশন চার্চে ইংরেজিতে যীশুর উপাসনা করা হত। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই দুটি চার্চ মিশে যায় এবং Calcutta Diocese of the CNI (Church of North India)-এর শৃঙ্খলায় আসে। 


শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজ 

'অক্ষরের শহর' শ্রীরামপুরে ব্যবসা-বাণিজ্যও বেশ উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৪ সালে হাওড়া-শ্রীরামপুর রেল-যোগাযোগ শুরু হয়, এবং রেলের সাথে সাথে বিপুলভাবে শ্রীরামপুরের শহরীকরণ এবং শিল্পায়ন শুরু হয়। ১৮৬৬ থেকে ১৯১৫ অবধি হুগলীতে প্রায় ৫-৬টি চটকল খুলে যায়। বিহার, ওড়িশা, অসম, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে সস্তার পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড় বাড়তেই থাকে। আজ শ্রীরামপুরের multicultural জনগণের কারণ এরাই। 

তবে এই শহরের কাপড়ের ব্যবসার এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করলে ব্যোমকেশ চক্রবর্তী এবং তাঁর সহকারীরা মিলে ১৯০৬ সালে মাহেশে স্থাপন করেন বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল। জাতীয়তাবাদের সাথে স্বাধীনতার লড়াই, সাথে ব্যবসা - এমন একসাথে তখন কেউ দেখেনি। 

যাই হোক শ্রীরামপুর কলেজের দক্ষিণে আছে Government College of Engineering & Textile Technology, Serampore (GCETTS)। ১৯০৮ সালে এই কলেজ শুরু হয়, তখন নাম ছিল Government Central Weaving Institute - দেওয়া হত দুই বছরের সার্টিফিকেট। ১৯২৬ থেকে মহিলারাও এই কলেজে পড়াশুনা করতে পারতেন। ১৯৩৮ সালে এখানে চালু হয় তিন-বছরের ডিপ্লোমা। স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে এখানে B.Tech in Textile technology পড়ানো শুরু হয়। 


তথ্যসূত্রঃ

https://puronokolkata.com/2014/05/31/baptist-mission-press-circular-road-calcutta-1818/
https://www.printweek.in/features/print-history-baptist-mission-press-in-calcutta-the-final-decades-56979
https://www.oldindianphotos.in/2015/01/bapist-mission-press-in-calcutta.html
https://www.anandabazar.com/west-bengal/howrah-hoogly/পঞ-চ-নন-কর-মক-রক-ভ-ল-ছ-শ-র-র-মপ-র-1.86168
https://www.panchforon.in/2014/01/blog-post_13.html
https://www.desh.co.in/storydetail/-/deshstory/বিস্মৃতির%20ইতিহাস:%20পঞ্চানন%20কর্মকার-155288
https://www.telegraphindia.com/culture/for-the-tongue-the-design-panchanan-karmakars-creation-first-bengali-font-for-type-casting/cid/2010168
যখন ছাপাখানা এলো - শ্রীপান্থঃ https://www.agcbosecollege.org/images/library/যখন%20ছাপাখানা%20এলো%20-%20শ্রীপান্থ_compressed.pdf
Learn the history of how Panchanan Karmakar created Asia's first Bengali font | Serampore: https://www.youtube.com/watch?v=mX0Eu-NNdgw
https://www.tbsnews.net/bangla/ইজেল/news-details-134530
https://www.oldindianphotos.in/2015/01/bapist-mission-press-in-calcutta.html

No comments: