মাহেশ, জননগর, বল্লভপুর, আকনা ঘুরে এইবার যাচ্ছি শ্রীরামপুর জলকল-এ।
কলকাতায় জল সরবরাহ শুরু হয় ১৮৭০ সাল নাগাদ। তার আগে গঙ্গার জল বড় বড় জালায় ভরে রাখা হত। শোনা যায় যে ব্রিটিশরা ১৮৯৪ সাল থেকেই গঙ্গার জল নিয়ে গবেষণা করত। তখন জানা যায় পলতার জল বেশি লবণাক্ত, সেই কারণেই পলতায় পানীয় জল শোধনাগার গড়ে ওঠে। পলতা-বারাকপুরের বিপরীতে রয়েছে শ্রীরামপুর (হুগলী) - সেখানকার জল তুলনায় কম লবনাক্ত। ফলে এখানে জল সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয় হাওড়া এবং হুগলীতে জল সরবরাহের জন্য।
১৮৯৬ সালের ১০-ই জানুয়ারি বাংলার ছোট লাট আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি ৮২ বিঘা জমির উপর বার্ন কোম্পানির হাতে তৈরি করা হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির পানীয় জল ব্যবস্থা উদ্বোধন করেন। এরমধ্যে জল থিতানোর জন্যে ৪ টি পুকুর এবং পরিশোধনের জন্য ১১ টি ফিল্টার বেড আছে। আজ এরই নাম হাওড়া ওয়াটার্স ওয়ার্ক্স - এখান থেকে দৈনিক ১২৬ লক্ষ গ্যালন জল হাওড়া শহরের পঞ্চানন তলা রোড, সালকিয়া, কৈপুকুর এবং শিবপুর জলাধারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
জলকলের ভিতরে পুরোনো বাড়ী ১ |
জলকলের ভিতরে পুরোনো বাড়ী ২ |
জলকলের ভিতরে পুরোনো বাড়ী ৩ |
জল পেরিয়ে যেতে হবে.... |
বাঁদিকের গাছটি শ্যাওড়া গাছ - ভূতের বাসস্থান বলে মনে করা হয় |
মদনমোহন মন্দির দর্শনের পর স্থানীয় লোকদেরকে জিজ্ঞেস করে শ্রীরামপুর জলকলের পিছন দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে আসুন হেনরি মার্টিনের প্যাগোডায়। কাছেই দে স্ট্রীটের গেট দিয়েও ঢুকে পরতে পারেন এখানে।
এই হেনরি মার্টিনস প্যাগোডাটিই নাকি প্রথম রাধাবল্লভ মন্দির, যা ১৫৭৭ সালে রুদ্ররাম বানিয়েছিলেন। পরে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হলে ভাঙ্গনের ভয়ে রুদ্ররাম এখন যেখানে রাধাবল্লভ মন্দির সেখানে নতুন করে মন্দির তৈরি করে পুজো-আর্চা চালিয়ে যান। কালের নিয়মে এই মন্দিরটি একসময় জঙ্গলে ঢাকা পরে যায়, কিছু অংশ ভেঙ্গেও পড়ে। ১৮০২ সালে এই জায়গাটি কিনে নেন ডেভিড ব্রাউন। উনি ছিলেন কলকাতা বাইবেল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। উনি এসে অল্ডিন হাউসটি তৈরি করে এখানে থাকা শুরু করেন।
ভাঙ্গা মন্দির/হেনরি মার্টিন্স প্যাগোডা (সংস্কারের আগে) (সূত্রঃ ইণ্টারনেট) |
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা স্নাতক গণিতবিদ হেনরী মার্টিন ভবিষ্যতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করবেন ভেবেছিলেন কিন্তু শেষ অবধি যাজক হেনরি কর্নওয়ালের সাথে ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষের দিকে পাড়ি দিলেন। ১৮০৬ সালে শ্রীরামপুরে এসে পৌঁছান হেনরি মার্টিন। মিশনারী হেনরি মার্টিন এখানে গঙ্গার ধারে এই ভাঙ্গা মন্দিরটিকে সাফসুতরো করে থাকা শুরু করলেন - তৈরি হল একটি ক্রিশ্চান প্রার্থনাস্থল, প্রকারন্তে এটিই ছিল শ্রীরামপুরের প্রথম গির্জা। লোকমুখে নাম হয়ে গেল হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা। একে একে এখানে ভিড় বাড়তে লাগল - শান্ত, নির্জন নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে এই গির্জা সকলের কাছে শান্তির স্থান হয়ে উঠল। উইলিয়ম কেরির সভাপতিত্বে এই মন্দির–গির্জায় নিয়মিত প্রার্থনা ও বিয়ে হতে লাগলো।
হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা (২০২০) - আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সংস্কারের পরে |
হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা (ডিসেম্বর ২০২৩) - প্রকৃতি আবার দখল নিচ্ছে |
ব্রাউন সাহেবের বদান্যতায় রাধাবল্লভের শূন্য দেবালয়ে প্রভু যীশুর নিত্য উপাসনা করতে লাগলেন হেনরি মার্টিন এবং আশ্চর্যের বিষয়, তৎকালীন বঙ্গসমাজে ধর্মীয় বিভেদ প্রকট থাকলেও ভারতবর্ষ আর একবার প্রমাণ করে দিয়েছিল “খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাই”।
একসময় হেনরি মার্টিন শ্রীরামপুর ছেড়ে চলে যান, পড়ে থাকে তার সাধের প্যাগোডা। ততদিনে সেণ্ট ওলাভস চার্চে কাজকর্ম শুরু হয়ে যাওয়ায় এই মন্দির/চার্চ নিয়ে কেউ আর বেশি মাথা ঘামায়নি।অনুবাদক হেনরি মার্টিন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেন ১৮০৯ সালে, রওনা দেন পারস্যের উদ্দেশ্যে। লম্বা ভ্রমণে পথশ্রমে ক্লান্ত হেনরি ১৮১২ সালের ১৬ই অক্টোবর তুরস্কের টোকাটে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হন, টোকাটে আর্মেনিয়ান চার্চে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। আর তাঁর ডায়েরিটি ইতিহাসের কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে যায়।
একসময় রামের ডিস্টিলারি হয়ে ওঠে এটি - 'প্যাগোডা রাম' তৈরি হত এখানে । সেও একসময় বন্ধ হয়, পরে জলকল এই চত্বরটিকে অধিগ্রহণ করে। হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা হয়ে উঠেছিল ভাঙ্গা মন্দির। নেশার আডডাও বসত দিনে রাতে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কিছুদিন আগে এই মন্দিরটিকে সংস্কার করেছেন। যদিও খুবই বেমানান সেই সংস্কার।
এখানে আসতে আসতে ডানদিকে দেখতে পাবেন জলকলের চৌকো পুকুর গুলোর উল্টোপাশে একটি ভাঙ্গা বাড়ি - অল্ডিন হাউস।
অল্ডিন হাউস - শ্রীরামপুর কলেজের শুরু যেখানে |
এখানেই ১৮১৮ সালের ১৫ই জুলাই শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর কলেজের প্রথম ক্লাস। সেও এখন পোড়ো বাড়ি হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে - বেরিয়ে আছে ইটের পাঁজর, দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা, ছাদ ফুঁড়ে উঠেছে বটগাছ, আনাচে কানাচে সাপখোপের বাসা। ণেশা করতেও বোধহয় এখানে কেউ যায় না।
ডেভিড ব্রাউন এই বাড়ি থেকে কলকাতা চলে যাওয়ার পাঁচ বছর বাদে এখানেই শুরু হয় শ্রীরামপুর কলেজের পঠনপাঠন। ১৮২১ সালে কলেজ স্থানান্তরিত হয় আজকের জায়গায়।
২০১৮ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানায় কলেজের আতুরঘর - অল্ডিন হাউসকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সে কাজও খুব বেশি এগোয়নি।
এসব নিয়ে শ্রীরামপুর জলকল দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের পাতার এককোণে।
তথ্যসূত্রঃ
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/rosysingh/history-of-the-henry-martins-pagoda-in-serampore-built-by-henry-martins-in-the-nineteenth-century/
No comments:
Post a Comment