Pages

Thursday, February 16, 2023

শ্রীরামপুরঃ মাহেশ - জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা

প্রথমেই আসি মাহেশ-এ। শ্রীরামপুরের মেন টাউন থেকে একটু দূরে মাহেশ এর রথযাত্রা পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন রথযাত্রা (প্রাচীনতমটি হল পুরীর)। 


শোনা যায় নিজের হাতে জগন্নাথদেবকে ভোগ খাওয়াবেন এই ইচ্ছা নিয়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙ্গালী সাধু পুরী গেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধল পুরীর ওড়িয়া পাণ্ডারা। তারা তাঁকে মেরেধরে মন্দির থেকে বের করে দিল। তখন দুঃখিত, অপমানিত ধ্রুবানন্দ আমরণ অনশনে বসলেন। তৃতীয়দিনে স্বপ্নাদেশ পেলেন ধ্রুবানন্দ, ভাগীরথী নদীর ধারে বাংলায় মাহেশ নামে এক জায়গায় ভগবান এক দারুব্রহ্ম (নিমকাঠ) পাঠাবেন এবং ধ্রুবানন্দ যেন সেই দারুব্রহ্ম থেকে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি বানিয়ে পুজো শুরু করেন এবং জগন্নাথদেব সেখানেই ধ্রুবানন্দের হাতের ভোগ খাবেন। প্রভু বললেন, ‘পাবে কাষ্ঠ তুমি, সুরধুনী নীরে কর গিয়া উত্তোলন। দারু কারুকর পাইবে সত্ত্বর যাহা হবে প্রয়োজন।’ 

সেই মতোই ১৩৯৬ সালে মাহেশে প্রতিষ্ঠা হল জগন্নাথ মন্দির। ধ্রুবানন্দ সেই তিনটি দারুব্রহ্ম দিয়ে বানালেন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি। আজও সেই মূর্তিদেরই পুজো হয়ে আসছে। এখানে পুরীর মতো মূর্তিদের 'নবকলেবর' হয় না। তবে বারো বছর পর পর মূর্তিগুলিকে নতুন করে রং করা হয় - এই 'অঙ্গরাগ' হয় রথযাত্রার দুই সপ্তাহ আগে এবং স্নানযাত্রার দুই দিন পরে। এই সময় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার দর্শন বন্ধ থাকে। 

দারুব্রহ্ম নির্মিত জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা

১৫ শতকে পুরী যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪) হুগলী জেলায় আসেন। প্রথমে যান বৈদ্যবাটীতে - সেখানে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেন, সেই ঘাটের নাম আজ নিমাইতীর্থ ঘাট। এরপর চৈতন্যদেব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে আসেন, এবং সমাধিস্থ হন। তখন ধ্রুবানন্দ বৃদ্ধ এবং অসুস্থ, উনি চৈতন্যদেবকে অনুরোধ করেন এই মন্দিরের দায়িত্ব নিতে। চৈতন্যদেব সেই অনুরোধে সাড়া দিতে বাধ্য হন - তাঁর দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম গোপাল কমলাকর পিপলাইকে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবায়েত করে পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শ্রীচৈতন্য মাহেশকে 'নব নীলাচল' (নতুন পুরী) বলে আখ্যা দেন। 

নবরূপে মাহেশের জগন্নাথ মন্দির (২০২১)

কমলাকর পিপলাই ছিলেন মেদিনীপুর জেলার কাঁথির কাছেই খালিজুলি গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। জগন্নাথ মন্দিরের প্রস্তর ফলকে লেখা থেকে জানা যায়, তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৪৫৫ শকাব্দে (বাংলা ৯৪০ সালে)। তাঁর তিরোভাব ঘটে ১৪৮৫ শকাব্দে (বাংলা ৯৭০ সালে/1562 খ্রীষ্টাব্দ)। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধররাই এই মন্দিরের সেবায়েত বা মন্দির অধিকারী হয়ে আছেন। সুধীর কুমার মিত্রের 'হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ' (সম্পাদনাঃ সৌমিত্র শঙ্কর সেনগুপ্ত এবং পল্লব মিত্র, দে'জ পাবলিশিং, দুই খণ্ড) অনুযায়ী নবাব খাঁনে আলি খাঁন ১৬৪৯-৫০ সাল নাগাদ গঙ্গানদীপথে নৌকা করে অসুস্থ কন্যাকে নিয়ে সুতানটি যাচ্ছিলেন এক কবিরাজকে দেখাতে, হঠাৎ ভীষণ ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে এই জগন্নাথ মন্দিরেই আশ্রয় নেন। তৎকালীন সেবায়েত রাজীব লোচন চক্রবর্তীর কথায় নবাব তাঁর মেয়েকে জগন্নাথের চরণামৃত এবং তুলসীপাতা খাওয়ান। পরদিন নবাব বিদায় নেন এবং প্রায় ৬ মাস বাদে নবাব আবার ফিরে আসেন মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে - সেবায়েত বংশকে 'অধিকারী' উপাধি প্রদান করেন এবং 'জগন্নাথপুর' গ্রামকে নিষ্কর দেবোত্তর ঘোষণা করেন। জমিদারপ্রথা বিলুপ্তির পরে, বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি কারণে ওই সম্পত্তি আইনগতভাবে মন্দিরের পাওনা হলেও সেসবই আটকে আছে। 

এখানে একটা খটকা আছে, ১৩৯৬ সালে ধ্রুবানন্দ যদি মন্দির/সাধনকুঠী প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলার ৯৪০ সালে (১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দ) কমলাকর পিপলাই মন্দিরের প্রথম সেবায়েত হন - তাহলে কি ধ্রুবানন্দ ১০০ বছরের বেশি বেঁচে ছিলেন? মাহেশের মন্দির ঘিরে আছে স্থান-কালের অনেক অস্বচ্ছতা! শ্রীরামপুর পৌরসভার ওয়েব সাইট বলছে ১৫৫৩ সালে ধ্রুবানন্দ দেহত্যাগ করেন।
 
ধ্রুবানন্দের সাধনপীঠে সম্ভবত প্রথম মন্দির তৈরি করে দেন শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায় - সঠিক সময়কাল জানা না থাকলেও মোটামুটি ইংরেজি ১৭২০-৪০ খ্রীষ্টাব্দ-এর মধ্যে এই মন্দির ছিল। সে মন্দির আজ অবলুপ্ত। সেই সময় থেকে মাহেশের সেবাইতদের আমন্ত্রণে শেওড়াফুলি রাজপরিবারের প্রতিনিধিগণ রূপোর ছত্র ও রৌপ্যদন্ড নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে এসে উপস্থিত হয়ে জগন্নাথদেবের মাথায় ছাতা ধরলে তবেই শুরু হয় জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। 

শেওড়াফুলি রাজপরিবারের প্রতিনিধিগণ রূপোর ছত্র ও রৌপ্যদন্ড নিয়ে মাহেশ যাচ্ছেন (সূত্রঃ ফেসবুক)

শেওড়াফুলি রাজবাড়ীর মেয়ে তথা অধ্যাপিকা বাসবী পালের কাছ থেকে জানা যায়, একবার রাজা হরিশচন্দ্র রায়ের আমলে শ্রীরামপুরের এক ব্যবসায়ী মাহেশের সেবাইতদের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে রাজপরিবারের সদস্যদের ছত্র ও রৌপ্যদন্ড নিয়ে পৌঁছানোর পূর্বেই ছাতা নিয়ে গিয়ে স্নানযাত্রার সময় জগন্নাথের মাথায় ছাতা ধরেন । এই কথা জানার পর রাজা রেগে গিয়ে ঐ ব্যবসায়ীকে ধরে এনে শেওড়াফুলি রাজবাড়ীতে দুদিন আটকে রাখেন। পরে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেন। তার পর থেকে আর অন্য কেউ জগন্নাথের মাথায় ছাতা ধরেননি।

আজকে আমরা যে মাহেশের জগন্নাথ মন্দির দেখতে পাই সেটি গড়ে দিয়েছিলেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নয়নচাঁদ মল্লিক। ১৭৫৫ সালে (১১৬২ বঙ্গাব্দ) প্রায় ৩ বিঘা জমির উপর ৭০ ফুট উঁচু এই মন্দির গড়ে তুলতে খরচ হয়েছিল তখনকার সময়ে ২০ হাজার টাকা। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি এই মন্দিরের নির্মাণ শৈলীতে উড়িষ্যার রেখা দেউল রীতি চোখে পড়ে।

এই মন্দির গড়ে উঠলেও অব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমে সেবায়েতরা কেউ রাজি হননি। সাথে নয়নচাঁদ চেয়েছিলেন তাঁর নামেই যেন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। এই সবকারণে মন্দির প্রতিষ্ঠা হলেও জগন্নাথ ছিলেন সেই আগের মন্দিরেই। এর মধ্যে নয়নচাঁদ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর পুত্র এসে মধ্যস্থতা করলে এই মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি এনে স্থাপিত হয়।

পরবর্তী কালে মল্লিক পরিবারের নয়ন চাঁদ মল্লিকের পরবর্তী উত্তর পুরুষ পরমধার্মিক নিমাই চরণ মল্লিক ১৮৩৭ সালে (মতান্তরে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে, ১৮৫৮ সালে) ৩২ লক্ষ টাকার সম্পত্তি উইল করে বিগ্রহের নিত্যসেবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। মল্লিক বংশের উত্তরপুরুষ কাশীনাথ মল্লিকের বংশধরেরা নয়নচাঁদের পৌত্র রামমোহন মল্লিকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মন্দিরের সিংহদ্বার সংস্কার করেন ১৯৯৬ সালে (১৪০৩ বঙ্গাব্দ)।

এখন মূল জগন্নাথদেবের মন্দিরের নানা দিকে ছোট ছোট মন্দিরে রয়েছে নানান বিগ্রহ। তারমধ্যে শিবমন্দির, কমলাকর পিপলাইয়ের মূর্তি, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রী মা সারদা আর স্বামী বিবেকানন্দের তিন মূর্তি এক ঘরে। রয়েছে নীলমাধবের মূর্তি, শনি ও কালীর বিগ্রহ, বজরঙবলীর মূর্তি ইত্যাদি। 

নীলমাধব - মাহেশ জগন্নাথ মন্দির

মাহেশের মন্দিরের রথের ইতিহাসও অনেক লম্বা। ধ্রুবানন্দ না কমলাকর পিপলাই - কে শুরু করেছিলেন মাহেশের রথযাত্রা এই নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও বোঝা যায় যে এই রথযাত্রার বয়স ৫০০ বছরের কম তো কোনভাবেই নয়। আর বয়সে আর উন্মাদনায় মাহেশের রথযাত্রা বিশ্বে দ্বিতীয়, পুরীর পরেই। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকেই এই রথযাত্রার সূচনা হয় চন্দনযাত্রার মাধ্যমে। রথযাত্রা শুরুর আগে মাহেশের রথের ওপরে এক নীলকন্ঠ পাখি এসে বসে। পুরীর রথের চাকা ঘুরতে শুরু করলেই নাকি সেই নীলকন্ঠ পাখি উড়ে চলে যায়। আর সাথে সাথে মাহেশের রথের চাকাও ঘুরতে শুরু করে। তবে এই নীলকন্ঠ পাখিকে কেউই দেখতে পান না, শুধুমাত্র প্রধান পুরোহিত ছাড়া। তবে এসব-ই লোককথা। 

১৭৯৭ সালে শ্রীকৃষ্ণরাম বসু (রামকৃষ্ণদেবের পরম ভক্ত বলরাম বসুর দাদু) মাহেশের মন্দিরে একটি পাঁচ চূঁড়া বিশিষ্ট লোহায় মোড়া কাঠের রথ উপহার দেন৷ মাহেশ থেকে বল্লভপুরের রাস্তাও শ্রীকৃষ্ণরাম বসুর অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়। ১৮৩৫ সালে শ্রীকৃষ্ণরাম বসুর ছেলে গুরুপ্রসাদ বসু রথটিকে নতুন করে সংস্কার করেন। কিছুদিন বাদে এই রথটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এরপরে কালাচাঁদ বসু ১৮৫২ সালে এবং বিশ্বম্ভর বসু ১৮৫৭ সালে এক-একটি রথ দান করেন, কিন্তু সেগুলিও বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হওয়ার কারণ গুলির মধ্যে একটি হল বয়স্ক মানুষেরা চাইতেন রথের চাকার তলায় পড়ে মৃত্যু হলে স্বর্গবাসী হওয়া সম্ভব - এই করতে গিয়ে রথের চাকা এবং মূল কাঠামো বার বার নষ্ট হয়েছে। 

এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন তৎকালীন  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হুগলী জেলার দিওয়ান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র বসু। ওনার অর্থানুকূল্যে মার্টিন বার্ন কোম্পানি আজকের নয়-চূড়াবিশিষ্ট লোহার রথটি তৈরি করে দেন ১৮৮৫ সালে। এই রথটির উচ্চতা ৫০ ফুট, ওজনে ১২৫ টন, ৪ ফুট ব্যাসের ১২ টি চাকার উপর ভর দিয়ে এগিয়ে চলে। রথটির সামনে দুটি তামার ঘোড়া লাগানো আছে। রথের একতলায় চৈতন্যলীলা, দোতলায় কৃষ্ণলীলা, তিনতলায় রামলীলা চিত্রিত। ১৮৮৫ সালে এই রথটি বানাতে ব্যয় হয়েছিল ২০ লাখ টাকা। রথের সময় এই বিশাল রথটিকে দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যান অসংখ্য ভক্ত। রথ থেকে উলটোরথ - ৮ দিন মেলা বসে এই এলাকায় এবং আরো ১০-১৫ দিন ধরে সেই মেলা কমবেশি চলতে থাকে। ভিড় হয় মারাত্মক - হিসেব বলছে ২-৩ লাখ মানুষ প্রতিবছর আসেন মাহেশের রথযাত্রা দেখতে। এই রথযাত্রা দেখতে এসেছেন বহু বিখ্যাত মানুষ - শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রী সারদাদেবী, বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও প্রমূখ। বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাধারাণী' উপন্যাসে মাহেশের এই রথযাত্রার বর্ণিল বিবরণ পাওয়া যায়। 

মাহেশের রথ

১৮৮৫ সালের পর থেকে এই রথের রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছেন শ্যামবাজারের বসু পরিবার। কোভিড আবহে ২০২০ এবং ২০২১ সালে মাহেশের রথের চাকা নড়েনি। এদিকে রোদে জলে রথের কাঠের অবস্থা হয়েছে আরো খারাপ। বছর বছর এই কাঠের কাজ করতে খরচা হত ৩-৪ লাখ টাকা। ২০২২ সালে সেই খরচা আরো বাড়বে, তাই এগিয়ে এসেছেন অনেকেই - তৈরি হয়েছে রথ সংস্কার কমিটি। 

রথযাত্রায় ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় পোলাও খিচুড়ি,আলুর দম,ধোঁকার ডালনা,পনীরের একটা পদ এবং পায়েস। মাহেশের জগন্নাথদেব মন্দিরের ভোগ নিয়ে একটা খুব চালু কথা আছে, তাহলো, " খিচুড়ি, অন্ন, পায়েস/এই নিয়ে মাহেশ।" এছাড়াও দুই রথযাত্রার মধ্যবর্তী দিনগুলিতে নানান পদ রান্না করে তিন বিগ্রহকে নিবেদন করা হয়। 

"নিত্য পূজা, নিত্য ভোগ, নিত্য শাস্ত্র পাঠ/ ভক্তজনে জানে তাই মাহেশ শ্রীপাট"। সাধারণ দিনে ভোর সাড়ে চারটেতে শুরু হয় মঙ্গলারতি। তারপর সকাল সাতটা থেকে ন'টা পর্যন্ত চলে পুজার্চনা। তারপরে বাল্যভোগ। নানারকম ফল,মিষ্টি, মাখন আর মিছরি দেওয়া হয় বাল্যভোগে। দুপুর বারোটায় মধ্যাহ্নভোগ নিবেদন করা হয়। কোনো দিন খিচুড়ি ভোগ কোনোদিন  অন্নভোগে সাথে নানারকম ভাজা, শুক্তো, ছানা বা পনিরের তরকারি, ধোঁকার ডালনা এবং আরও নানা ব্যঞ্জন। অড়হড় ডাল থাকে, যা জগন্নাথের খুবই প্রিয়। সাথে আলু পটলের তরকারি কিংবা আলু মোচার পদও থাকে। গোবিন্দভোগের চাল, দেরাদুন চাল এবং কামিনী আতপ চালের ভোগও দেবতাদের নিবেদন করা হয়। ভাজায় নানারকম সব্জী ব্যবহার করা হলেও শাকের মধ্যে পুঁই শাক এবং কলমি শাক ব্যবহার করা হয় না। এছাড়াও আম, আমড়া, জলপাই প্রভৃতির চাটনি একেকদিন। মরশুমে যখন যেমন পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে চাটনি নিবেদন করা হয়। মিষ্টির মধ্যে পায়েস ছাড়াও রকমারি মিষ্টি থাকে। বিকেল ৪টেয় বৈকাল ভোগ এবং শাস্ত্র পাঠ হয়। ৬টায় সন্ধ্যারতি এবং নাম সংকীর্তন, সাড়ে ৬টায় শীতল ভোগ হয়। রাত ৯টায় মন্দির বন্ধ হয়। 

রথের যাত্রাপথও বদলেছে বেশ কয়েকবার। একসময় রথ যেত বল্লভপুর অবধি, পরে চাতরার গুণ্ডিচাবাটি অবধি, এখন জগন্নাথের মাসির বাড়ি অবধি যায়। স্নানযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে দুধ এবং ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। ভাদ্রমাসে ষাঁড়াষাঁড়ি বানের সময় মাটির কলসীতে এই গঙ্গাজল যোগাড় করেন রিষড়ার কুমোররা। বংশ পরম্পরায় এনারা পায়ে হেঁটে এই জল দিয়ে যান মন্দিরে। এত স্নান করে ওনাদের ধুম জ্বর আসে। স্নানযাত্রা থেকেই বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের দরজা - কম্বল-চাদর জড়িয়ে গর্ভগৃহে শুয়ে থাকেন ঠাকুর। এমত অবস্থায় আরামবাগ, গোঘাট, ঘাটাল, উদয়নারায়ণপুর, আমতা, বিষ্ণুপুর আরও নানা জায়গা থেকে চিকিৎসকেরা আসেন, এবং মন্দিরে বসে ভক্তি এবং নিষ্ঠাভরে বিভিন্ন গাছপাতা, জড়িবুটি বেঁটে তৈরি করেন পাঁচন। সেই পাঁচন খেয়ে দেবতারা চাঙ্গা হয়ে ওঠেন, খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা এবং রথযাত্রা শুরু হয়। 

বর্তমানে মাহেশ শ্রীশ্রী জগন্নাথ জীউ উন্নয়ন ট্রাস্ট এর অধীনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় - উপনয়ন, বিবাহ, পাকা দেখা, অন্নপ্রাশন, চুলদান, কনে দেখা, আশীর্বাদ, গাড়ি পুজো ইত্যাদি। 


২০২০ সালে প্যান্ডেমিকের আগে থেকেই মন্দির সংস্কারের কাজ শুরু হয় - যারা আগে দেখেছেন, তারা এখন চিনতেই পারবেন না ঝকঝকে মন্দির প্রাঙ্গণে এসে। নাটমন্দিরও তৈরি হয়েছে নতুন করে। জি.টি. রোডের উপর তৈরি হয়েছে প্রবেশদ্বার। রাজ্য সরকারের তরফে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়াও হয়েছে মাহেশকে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য। মাহেশে গঙ্গার ধারে ইকো ট্যুরিজম রিসর্ট গড়ে তোলার ব্যাপারেও কথা চলছে - থাকবে কটেজ, ডর্মেটরি, পিকনিক স্পট এবং লোকশিল্পীদের অনুষ্ঠানের জায়গা।

স্নানমঞ্চের দিকের গেট

মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবাইত এখন সৌমেন অধিকারী। সৌমেনবাবুর পুত্র পিয়াল অধিকারী সোস্যাল মিডিয়াতে বেশ জনপ্রিয়। আপনি যদি বেড়াতে এসে জগন্নাথের ভোগ খেতে চান ওনাদের সাথে আগেভাগে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে - 9836762826। 

হেঁটেই দেখে নিল মূল জগন্নাথের মন্দির এবং নাটমঞ্চস্নানমঞ্চ, জিটি রোডের উপর নবনির্মিত জগন্নাথ তোরণ এবং জিটি রোডের পাথে দাঁড়িয়ে থাকা মাহেশের রথটিকে।

জগন্নাথ মন্দিরের প্রবেশ দরজা 

মন্দিরে ঢুকতে ডানদিকে

জগন্নাথ মন্দিরের নাটমন্দির (২০২৪)


জগন্নাথদেবের স্নানমঞ্চ (২০২০)

জগন্নাথ মন্দির এবং স্নানমঞ্চ (২০২০)

জগন্নাথ তোরণ (2024)

উত্তরে একটু এগিয়ে গিয়ে ৭০০-৮০০ মিটার দূরে আছে জগন্নাথের মাসির বাড়ি - একদম সাধারণ এই মন্দিরটি। কিছুদিন আগেই এই মাসির বাড়ির সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। এই মাসি আসলে জগন্নাথের বান্ধবী, পৌর্ণমাসি। ঝা চকচকে টাইলস আর মার্বেলের মেঝে সহ আধুনিক একতলা বাড়ির মত অত্যন্ত সাদামাটা এই মন্দিরের কোনো বিশেষ স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্য নেই। 

২০২০ - সংস্কারের কাজ চলছে জগন্নাথের মাসির বাড়ির

জুলাই ২০২১ - সংস্কার প্রায় শেষ


এরপর চলে আসি জগন্নাথ ঘাট-এ। মন্দিরের কাছেই এই ঘাটটির মূল ঘাটবাড়ি থেকে গঙ্গা এখন অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। ঘাটবাড়িটির সাথেই আছে দুটি শিব মন্দির। মন্দিরদুটির অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও মূল ঘাটবাড়িটির একেবারেই দৈন্যদশা - চুন সুরকির ছাদ ফাটিয়ে বট অশ্বত্থের ্মূল বেড়িয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ফাটল, চাঙড় খসে পড়েছে। ঘাটের বাইরে একটি চার-থাম সহ একতলা বাড়িও দেখতে পাবেন - সম্ভবত এটি একসময় স্টোরহাউস হিসেবে ব্যবহার হত।

Jagannath Ghat

Jagannath Ghat


Jagannath Ghat

Jagannath Ghat


উত্তরে শিবমন্দিরের গায়ে লেখা আছে: শ্রী শ্রী দুর্গা। সন ১২৭১ সাল। ৺বিজয়া দাসী। সাং আরপুলি। 
আর দক্ষিণের শিবমন্দিরে লেখা আছে: শ্রী শ্রী দুর্গা। সন ১২১৭ সাল। ৺রামচন্দ্র দত্ত। সাং আরপুলি। 
মূল ঘাটের চাঁদনি নির্মাতার নাম দেখা যায়: শ্রী শ্রী জগন্নাথ দর্শনার্থে কলিকাতা আরপুলি নিবাসী রামচন্দ্র দত্তের স্বর্গার্থে তদসম্ভব বিনির্মিত এই ঘট্ট। শকাব্দ ১৭৮৫।
মাহেশের রথের সময় কলকাতা যে বাবুরা আসতেন তাদেরই একজন এই রামচন্দ্র দত্ত।  
মাহেশের স্নানযাত্রার মেলার আগের দিন থেকে জগন্নাথ ঘাটে ভিড়ত বাবুদের বিলাসতরী বা বজরা। বিলাসিতার সমস্ত আয়োজন তাতে, সারারাত চলত বাইজি নাচ আর আমোদ প্রমোদ। কে কত পয়সা ওড়াতে পারে তা নিয়ে চলত বাবুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। 

Jagannath Ghat

Jagannath Ghat

Jagannath Ghat

জগন্নাথ ঘাটের ঠিক পাশেই আছে একটি শশ্মান ঘাট এবং ফেরি ঘাট। এই ফেরি উল্টোদিকের টিটাগড়ের লক্ষীঘাটের সাথে যুক্ত।

জগন্নাথ ঘাটের পাশেই ছিল বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল (Bengal Luxmi)। বঙ্গভঙ্গের পরে ১৯০৬ সালে ব্যোমকেশ চক্রবর্তী এবং অন্যান্যরা মিলে এই মাহেশেই প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গলক্ষী কটন মিল। বিদেশি দ্রব্য বর্জন এবং দেশী জিনিস ব্যবহার করা - এই ছিল এই স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্য। পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে অনেকগুলি কটন মিল এবং জুট মিল গড়ে ওঠে। কাছেই জিটি রোডের ওপাড়ে ছিল রামপুরিয়া কটন মিল। 

আজ সেই সব কারখানার চাকা বন্ধ। থাবা বাড়িয়েছে রিয়াল এস্টেট - বঙ্গলক্ষী কটন মিলের জমিতে তৈরি হচ্ছে নিউ কলকাতা হাউসিং কমপ্লেক্স। আর রামপুরিয়া হচ্ছে সোলারিস সিটি। 

জগন্নাথ ঘাট থেকে নিউ কলকাতার হাইরাইজ (বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল)


শ্রীরামপুরের মাহেশ পাবলিক লাইব্রেরিও এক ইতিহাসের দলিল। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরি হুগলী জেলার অন্যতম পুরোনো গ্রন্থাগার। রবিবার এবং ইংরেজি মাসের ২য় এবং ৪র্থ শনিবার বাদে প্রতিদিন এটি দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৮ টা অবধি খোলা থাকে। আজকের ইন্টারনেটের যুগে লাইব্রেরিগুলিতে ভিড় কমেছে দেখার মত। তা সত্ত্বেও মাহেশের লাইব্রেরিতে পুরোনো ম্যাগাজিন এবং বই ঘাঁটতে অনেকেই আসেন। ঠিকানা: ৪৮ জি.টি. রোড, মাহেশ, হুগলী, পিনকোড- ৭১২ ২০২। গুগল ম্যাপেও খুঁজলে সহজেই পেয়ে যাবেন এর ঠিকানা।

মাহেশ শ্যামসুন্দর মন্দির
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির এবং মাসির বাড়ির মাঝে একদম জি,টি, রোডের উপরে রয়েছে এই শ্রীশ্রীঁ শ্যামসুন্দর জীউর মন্দির। স্বর্গত সুরেশ চন্দ্র বণিকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে (শুভ অক্ষয় তৃতীয়া, বাংলার ১৩৮০ সন)। 

মাহেশ যাওয়ার রাস্তায় হঠাৎ করেই চোখে পড়ে যায় এই মন্দিরের চূড়াটি। যদিও বেশিরভাগ সময়েই এই মন্দিরের ছাদে বিজ্ঞাপন থাকে, চূড়াটি দেখা যায় না। 

বর্তমানে এই মন্দিরের অবস্থান খুঁজে বের করা খুব সহজ - ঠিক পাশেই উত্তরদিকে খুলেছে ক্রোমা। 



কাছেই মানিকতলায় আছে মহেশ চন্দ্র দত্ত'র মিষ্টির দোকান - এই এলাকার সবথেকে পুরোনো মিষ্টির দোকান, এবং পরিবেশটাও আপনাকে নিয়ে যাবে ২০০-৩oo বছর আগে। কাঠের মিটসেফে টিনের বারকোশে রাখা সন্দেশগুলোর দাম তুলনায় কম, কিন্তু স্বাদে দুর্দান্ত, কারণ এই দোকান থেকেই মন্দিরে ঠাকুরের জন্য মিষ্টি যায়। শোনা যায় যে বল্লভপুরের শ্রীশ্রীরাধাবল্লভজীও নাকি এদের গুটকে সন্দেশের লোভ সামলাতে পারেননি, বাচ্চা ছেলের বেশে এসে গুটকে খেয়ে পড়লেন মহাবিপদে। দোকানি মহেশ চন্দ্র পয়সা চেয়েছেন যে। শেষমেশ শ্রীশ্রীরাধাবল্লভজী হাতের সোনার বালা খুলে দিলেন, বললেন বাবা এসে পরে পয়সা দিয়ে দেবেন। একটু বাদে মহেশচন্দ্র খবর পেলেন যে সত্যিই শ্রীশ্রীরাধাবল্লভজীর একহাতের সোনার বালা পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি হন্তদন্ত হয়ে বালাটি নিয়ে মন্দিরে হাজির হলেন। দেখা গেল যে শ্রীশ্রীরাধাবল্লভজীর একহাতের বালা এবং মহেশচন্দ্রর আনা বালা দুটি সম্পূর্ণ একই রকম। কেউ বলেন জগন্নাথও নাকি এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। 


কিকি খাবেন এখানে? সাদা দই, ছানার মুরকি, গুটকে সন্দেশ, মনোহরা, জলভরা। 

পরর্বতী সময়ে মহেশচন্দ্রের উত্তরাধিকারীরা শ্রীরামপুরের বটতলা ও চাতরাতে দুটি শাখা খোলেন। সেগুলিও যথেষ্ট ভালো৷ আমার মতে ব্যারাকপুরের কিছু মিষ্টির দোকান বাদ দিলে হুগলীর মিষ্টি স্বাদের দিক থেকে ভালো এবং দামও কম। 

যদি সকাল সকাল যান, মহেশের মিষ্টির দোকানের ঠিক উল্টোদিকে শিবুর টিফিন হাউসের হিঙের কচুরি অবশ্যই খেয়ে আসবেন৷ 

শ্রীরামপুরের ইংরিজি বানান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম ব্যবহার হয়েছে - Serampore, Srirampur, Srirampore, Shreerampur, Shreerampore। তবে শ্রীরামপুর রেলস্টেশনকে ভারতীয় রেল SHRIRAMPUR লেখে এবং আধুনিক ড্যানিশ কাগজপত্রে এবং শ্রীরামপুর কলেজের বানানে SERAMPORE বলেই লেখা আছে - তাই এই দুটি বানানই ব্যবহার করা উচিত। 

তথ্যসূত্রঃ 
১। https://pagefournews.com/mahesh-rath-yatra/
২। হুগলী জেলার ইতিহাস - https://www.facebook.com/groups/961975930909680/
৩। ট্যুর প্ল্যানার ব্লগের ফেসবুক গ্রুপে সমীরণ চন্দ্র বণিকের পোস্টঃ  https://www.facebook.com/groups/tourplannermagazine/posts/2322003107951994. https://serampore.weebly.com/index.html
5. https://www.maheshjagannath.org/history-of-mahesh-rath-yatra.php

No comments: