Pages

Saturday, February 18, 2023

শ্রীরামপুর: পর্ব ৩ - বল্লভপুরের রাধাবল্লভ জীউ মন্দির

এবার আসুন বল্লভপুর। এখানে দেখে নিন ২৫০ বছরের বেশি পুরোনো রাধাবল্লভ মন্দির, সংলগ্ন রাসমঞ্চ, রাধা বল্লভ ঘাট। পাশেই আছে গঙ্গার ধারে নবনির্মিত শশ্মানকালীর মন্দির এবং উগ্রতারা তীর্থ। এর ঠিক উলটো পাড়ে বারাকপুর ও টিটাগড়ের মাঝে অন্নপূর্ণা মন্দির এবং রাসমণি ঘাট।  

রাধাবল্লভ জীউ মন্দির

এই রাধাবল্লভের মন্দির থেকেই এই এলাকার নাম হয় বল্লভপুর। 

এই মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে দুটি মত আছে। একমত বলে যে এই মন্দিরের বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন রুদ্ররাম। রুদ্ররাম ছিলেন শাক্ত এবং তাঁর মামা ছিলেন শ্রীরামপুরের চাতরা নিবাসী বৈষ্ণবচূড়ামণী, শ্রীচৈতন্য পরিকর, পণ্ডিত কাশীশ্বর।

কাশীশ্বর পণ্ডিত ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া বৈষ্ণব। তিনি প্রতিদিন নিজের হাতে তাঁদের কুলদেবতা শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতেন। তিনি কোন অ-বৈষ্ণবকে এই বিগ্রহ  ছুঁতে দিতেন না। একদিন কোন কারণে তাঁর বাড়িতে ফিরতে দেরি দেখে তাঁর ভাগনে রুদ্ররাম শ্রীকৃষ্ণের পূজা সম্পন্ন করেন। বাড়ি ফিরে এসে কাশীশ্বর এই দেখে খুবই রাগ করেন এবং রুদ্ররামকে গালিগালাজ করেন। মনের দুঃখে রুদ্ররাম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে আকনায় (এখন বল্লভপুর) গঙ্গার ধারে এক জায়গায় আশ্রয় নেন এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রার্থনায় মগ্ন হন। 

অনেকের মতে রুদ্ররাম ছিলেন শাক্ত এবং এই বল্লভপুরে রুদ্ররাম যখন শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় বসেন, তখন এক সন্ন্যাসী এসে তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দিয়ে যান। এরপর রুদ্ররাম স্বপ্নাদেশ পান যে গৌড়ের রাজপ্রাসাদ থেকে শিলা সংগ্রহ করে এই স্থানে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে।  রুদ্ররাম গৌড়ে উপস্থিত হয়ে বাদশাহের হিন্দু প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যে একটি শিলাফলক সংগ্রহ করে বল্লভপুরে নিয়ে এলেন এবং ঐ শিলাফলকটির পূজার্চনা করতে লাগলেন। পরে  বৃন্দাবনের এক শিল্পী এসে ওই শিলাফলক থেকে তিনটি শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরী করে দেন। প্রথমটির নাম হয় রাধাবল্লভ, দ্বিতীয়টির নাম হয় শ্যামসুন্দর এবং তৃতীয়টির নাম হয় নন্দদুলাল। পরবর্তীকালে খড়দহ নিবাসী নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্র এই শ্যামসুন্দরের মূর্তিটির জন্য রুদ্ররামের কাছে আবেদন করেন। প্রথমে রুদ্ররাম রাজি হননি। এর পরে একদিন রুদ্ররাম যখন তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধ করছিলেন তখন অকস্মাৎ প্রবল বর্ষণে শ্রাদ্ধ পণ্ড হওয়ার উপক্রম হল। নিমন্ত্রিত বীরভদ্র অলৌকিক শক্তির প্রভাবে শ্রাদ্ধকাণ্ড রক্ষা করেন। এতে প্রীত হয়ে রুদ্ররাম বীরভদ্রকে এই বিগ্রহ দান করেন। 

শ্রীশ্রী রাধাবল্লভ

দ্বিতীয় মতে বীরভদ্রই এই শিলাটি নিজেই গৌড় থেকে নিয়ে আসেন। ১৫৪৫ সালে নিত্যানন্দ প্রভুর তিরোধানের পর একদিন বীরভদ্র দৈবাদেশ পান যে মালদহের নবাবের রাজপ্রাসাদের তোরণে রয়েছে একটি কালো পাথর, সেটিকে খড়দহতে এনে মূর্তি বানিয়ে সেবা করতে হবে। কিংবদন্তি অনুসারে, ওই পাথরটিকে রাজা পরীক্ষিৎ ওই তোরণে স্থাপন করেন। তার পর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে শ্রীকৃষ্ণ ওই পাথরটির উপর দাঁড়িয়ে যজ্ঞে আগত ব্রাহ্মণদের পা ধুইয়ে দেন।

দৈবাদেশ পেয়ে বীরভদ্র সপার্ষদ নামসঙ্কীর্তন করতে করতে হাজির হলেন তখনকার মালদহে। মালদহের নবাব সোলেমান খাঁ সংবাদ পেয়ে বীরভদ্রকে বন্দি করলেন এবং ষড়যন্ত্র করলেন, গোমাংস খাইয়ে বীরভদ্রের জাত নষ্ট করা হবে। রাজসভায় বীরভদ্রের সামনে ঢাকা দেওয়া একটি খাবারের থালা আনা হয়।অলৌকিক দৈব মহিমাবলে ঢাকনা সরানো হলে দেখা গেল, গোমাংসের বদলে থালায় রয়েছে ফুলের মালা। নবাব হার না মেনে আনালেন সুরার পাত্র, বীরভদ্রকে বললেন পান করতে। এ বারেও চমক, সুরাপাত্রে রয়েছে দুধ। এই সব দেখে নবাব বীরভদ্রের কাছে ক্ষমা চাইলেন। অনুরোধ করলেন, বীরভদ্র যদি তাঁর দৈব ক্ষমতার সাহায্যে নবাবের রুগ্ণ জামাইকে সুস্থ করে তোলেন। বীরভদ্র শর্ত দেন, জামাইয়ের সুস্থ শরীরের বিনিময়ে তিনি নিয়ে যাবেন রাজপ্রাসাদের তোরণে রক্ষিত বিশেষ কষ্টিপাথরটি। নবাব সম্মতি দিলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না, বীরভদ্র কী উপায়ে পাথরটি খুলে নেবেন? বীরভদ্রের নির্দেশে সুরার পাত্রের দুধটি জামাইকে পান করানো হয়। সাথে সাথেই নবাবের জামাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। অপর দিকে আচমকাই আকাশ জুড়ে খেলে যায় তীব্র বিদ্যুতের ঝলক। সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, বজ্রের আঘাতে তোরণ থেকে খুলে পড়েছে বিরাট এক কষ্টিপাথরের খণ্ড।

তোরণের কষ্টিপাথরটি কেমন করে মালদহ থেকে খড়দহে এল, সেও এক অলৌকিক কাহিনি। বীরভদ্র কষ্টিপাথরটি ভাল করে খড়ে জড়িয়ে মালদহের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রভু, তুমি খড়দহে যাও!’ আবার কারও মতে, বীরভদ্র গোস্বামী বাঁশের মাচায় খড়ের আবরণ দিয়ে পাথরটি জলপথে ভাসিয়ে খড়দহে পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়, পাথরটি জলে ভাসতে ভাসতে গঙ্গাতীরবর্তী আকনার একটি স্নানের ঘাটে এসে আটকে যায়। ঘাটে স্নানরত বালকের দল পাথরটিকে খেলার ছলে ঠেলে দিতেই পাথর আবার ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছয় খড়দার ঘাটে। এখন এই ঘাটের নামই শ্যামসুন্দর ঘাট। বীরভদ্র খড়দহে পৌঁছে পাথরটিকে উদ্ধার করেন এবং ভাস্করকে ধ্যানে দেখতে পাওয়া কৃষ্ণ বিগ্রহের বিবরণ দিয়ে মূর্তি গড়তে বলেন। ওই কষ্টিপাথর থেকে তিনটি কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি হয়। এই তিন বিগ্রহের মধ্যে বীরভদ্র ধ্যানে দেখা সত্য, শিব ও সুন্দরের প্রকাশ দেখেন শ্যামসুন্দর বিগ্রহে। অন্য দুই বিগ্রহের একটি পাঠানো হয় আকনায় রুদ্ররাম পণ্ডিতের কাছে। রুদ্ররাম বিগ্রহকে বল্লভ জীউ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতার নামে আকনার নতুন নাম হয় বল্লভপুর। বীরভদ্র তৃতীয় বিগ্রহের নাম রাখেন ‘নন্দদুলাল’। নন্দদুলালকে বীরভদ্র পাঠিয়ে দেন রুদ্ররামের কনিষ্ঠ ভাই লক্ষ্মণ পণ্ডিতের কাছে স্বামীবনে (সাঁইবোনা)।  

ভক্তদের বিশ্বাস করেন একই দিনে এই তিনটি বিগ্রহ দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। আবার অনেকের ধারণা, একই দিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে উপবাসী থেকে এই তিন বিগ্রহ দর্শন করলে কলির তিন প্রভু গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত দর্শনের পুণ্যলাভ হয়।

সম্ভবত ১৫৭৭ সালে রুদ্ররাম রাধাবল্লভের একটি আটচালা মন্দির গড়ে তোলেন। কিন্তু গঙ্গার ভাঙ্গনে মন্দিরের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেবায়তরা এই মন্দিরটিকে ত্যাগ করে আরো ভিতরদিকে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৬৪ সালে (১১৭১ বঙ্গাব্দ) কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক আজকে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি তৈরি করে দেন। এই নয়নচাঁদ-ই মাহেশের বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন (১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দ)। ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে তাঁর পুত্র নিমাই চরণ মল্লিক এই বিগ্রহের নিত্য সেবার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করেন। 

পুত্র মহিম চন্দ্র দত্ত-র অকাল মৃত্যুর পর তার স্মরণে ১৩২০ বঙ্গাব্দে (১৯১৩ সালে) মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরটি তৈরি করেন মহেশ চন্দ্র দত্ত। এই নাটমন্দিরটি পরে ১৩৬৭ সালে এবং ১৩৯৭ সালে সংস্কার করেন দৌহিত্র সুধীর চন্দ্র দাস। 

১৯৭৩ সালে বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্ট এই মন্দিরটির সংস্কার করেন।



১৯৭৩ সালে বিড়লা জন কল্যাণ ট্রাষ্ট মন্দিরের পূর্ণ সংস্কার করেন

রাধাবল্লভ মন্দিরের পাশে একটি পুরোনো বাড়ি

বল্লভপুরের মন্দিরের কাছেই আছে রাধাবল্লভ জীউ রাসমঞ্চ, রাধাবল্লভ জীউ ঘাট, এবং বল্লভপুরের শশ্মান ঘাট। 

রাধাবল্লভ মন্দিরের রাসমঞ্চ

চুন সুরকির ছাদ এবং বেশকয়েকটি থামের উপর দাঁড়িয়ে শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ জীউ ঘাট 

আগে শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ জীউ ঘাট থেকে উল্টোদিকে বারাকপুরের রাসমণি ঘাটের ফেরী চালু ছিল। এখন লম্বা জেটির কাজ চলছে। 


এই ঘাটের উত্তরে আছে বল্লভপুরের শশ্মান। সেখানে আছে শশ্মানকালীর মন্দির বা উগ্রতারা তীর্থ। ঐতিহাসিক গুরুত্ব না থাকলেও ঘুরে দেখা যেতেই পারে বল্লভপুরের শশ্মান। 

তথ্যসূত্রঃ
১) নবাব প্রাসাদের পাথর থেকে শ্রীশ্যামসুন্দর, আনন্দবাজার পত্রিকা -  https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/the-history-behind-khardaha-shri-shri-radha-shyamsundar-temple-1.1119385
২) শ্রীরাধাবল্লভ  জিউ'র  মন্দির, শ্রীরামপুর, হুগলি, শ্যামল  কুমার  ঘোষ  -http://templesofbengal.blogspot.com/2016/08/radhaballabh-jiu-temple-ballabhpur.html 

No comments: