Pages

Tuesday, February 28, 2023

শ্রীরামপুর: ড্যানিশ চার্চ - সেন্ট ওলাভস চার্চ


শ্রীরামপুরে ড্যানিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের 
গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে একটি হল এই ড্যানিশ চার্চ - যার পোশাকি নাম সেন্ট ওলাভ'স চার্চ। পাঁচু গোপাল ভাদুড়ী সরনীতে অবস্থিত এই চার্চটির নামকরণ হয় নরওয়ের ভাইকিং রাজা এবং পরে 'National Saint' সেণ্ট ওলাভ-এর নামে। 

১৭৫৫ সালে ড্যানিশরা শ্রীরামপুরে (বা ফ্রেডরিকনগর) উপনিবেশ স্থাপন করার পরে এখানে ধীরে ধীরে ড্যানিশ জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। কাজেই দরকার হয়ে পড়ে একটি উপাসনাস্থলের। ১৭৭৬ সালে ফ্রেডরিকগঞ্জের গভর্নর নিযুক্ত হলেন কর্নেল ওলি'বি। ডেনমার্ক থেকে চাঁদা তুলে মোটামুটি ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে প্রোটেস্ট্যান্ট নাগরিকদের প্রার্থনাস্থল স্থাপনের জন্য লুথারিয়ন গির্জার কাজ শুরু হয় শ্রীরামপুরের তৎকালীন গভর্নর ওলি'বি-র সময়।

 ১৪ হাজার স্কোয়ার ফুটের জমির উপর এই স্থাপত্য বানাতে সেই সময় খরচ হয়েছিল ১৮,৫০০ টাকা। চাঁদা এসেছিল ফ্রেডরিক্সনগর থেকে, কলকাতা থেকে, এমনকি সুদূর কোপেনহেগেন থেকেও। এমনকি কলকাতার ব্রিটিশ গভর্নর ওয়েলেসলিও ১,০০০ টাকা দিয়েছিলেন। ওলি'বি চেয়েছিলেন এক জমকালো চার্চ যা ড্যানিশ উপনিবেশ ফ্রেডরিকনগরকে এক আলাদা মাত্রা দেবে। কিন্তু চার্চের কাজ শেষ দেখে যেতে পারেননি ওলি'বি। 

Lt. Colonel Ola Bie. born at Tronohjem, Norway in Feb 1733. Died in Serampore on 18th May, 1805

কিন্তু ১৮০৫ সালে ওলি'সবির মৃত্যু হলে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন ক্রেফটিং। এই কাজে তাঁকে অনেকাংশে সাহায্য করেছিলেন দুই ব্রিটিশ নাগরিক - জন চেম্বারস এবং রবার্ট আর্মষ্ট্রং। এর ফলে সেণ্ট ওলাভস চার্চের স্থাপত্যকলায় ড্যানিশ গঠনশৈলীর থেকে ব্রিটিশ প্রভাব বেশি৷ ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের চার্চ অব আওয়ার লেডি-র থেকেও কিছু গঠনগত অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছিল। ১৮০৬ সালে এই চার্চটিতে প্রার্থনা শুরু হয়। সেই সময় পোর্টিকো এবং বেল টাওয়ার অবশ্য তৈরি হয়নি। আজকে যে রূপে চার্চটিকে দেখতে পাই সেই সম্পূর্ণ রূপটি পেতে পেতে হয়ে গেছিল ১৮২১। ১৮৩১ সালে বেল টাওয়ারে যুক্ত হয় একটি ঘড়ি - কলকাতার বিশপ রেভারেণ্ড ড্যানিয়েল উইলসন এটিকে উপহার দিয়েছিলেন। 

এই চার্চের বেল টাওয়ারে দুখানা ঘণ্টা আছে - যদিও এখন কোনটাই ব্যবহার হয় না। ছোট ঘণ্টাটি ফ্রেড্রিক্সবার্গের এক কামারশালায় তৈরি - ১৮০৪ সালে এটিকে আনা হয়েছিল। আর জার্মানির স্টুটগার্টে বানানো বড় ঘণ্টাটি ১৮৫৩ সালে লাগানো হয় -  ড্যানিশরা তখন শ্রীরামপুর ছেড়ে চলে গেছে - কাজেই ব্রিটিশরাই সম্ভবত এটি নিয়ে এসেছিল। 

St. Olav's Church - From the Front

চার্চের ভিতর ছয়টি মার্বেল ফলক আছে - ওলি'বি, উইলিয়ম কেরী, জশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়ম ওয়ার্ড, জুলিয়ানা মারিয়া ওয়ালিচ, জেও ভয়েট (JO Voigt) - এঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। শ্রীরামপুর মিশনের স্মরণেও একটি মার্বেল ফলক আছে। 

Lt. Col. Ole Bie's Memorial Plaque inside St. Olav's Church

প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ হওয়ায় এর ভিতরে কোন মূর্তি নেই - আছে একটি ক্রশ যার সামনে প্রতি রবিবার প্রার্থনা করা হয়। 

Side view of St. Olav's Church, Serampore

এই চার্চের সুউচ্চ চূড়া এবং চূড়ায় বসানো ঘড়ি গঙ্গার ওপারে বারাকপুর থেকেও দেখা যায়। এখনো বহুতলের ভিড়ে চার্চের চূড়া অনবদ্যভাবে বিদ্যমান। ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর ইংরেজের দখলে আসে, চার্চের ভার যায় বিশপ অফ ক্যালকাটার হাতে। আরো পরে চার্চের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় শ্রীরামপুর কলেজের হাতে। স্বাধীনতার পর থেকে এই চার্চের বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। কালের নিয়মে ঘড়িটিও বন্ধ হয়ে গেছিল। ফলে ২০০৯ সাল থেকে এই বেহাল, জরাগ্রস্থ চার্চে জনসুরক্ষার জন্য নিয়মিত প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়। 

২০১৩ সাল নাগাদ মূলত ড্যানিশ মিনিস্ট্রি অফ কালচারের উদ্যোগে এই চার্চের মেরামতির কাজ শুরু হয়। এগিয়ে আসে রাজ্যের হেরিটেজ কমিশনও। ডেনমার্কের ন্যাশানাল মিউজিয়মের 'শ্রীরামপুর ইনিশিয়েটিভ', শ্রীরামপুর কলেজ এবং কলকাতা ডাইওসিসের মিলিত উদ্যোগে সেণ্ট ওলাভ'স চার্চের সংস্কারের কাজ চলে প্রায় তিন বছর ধরে। ছাদ ঢালাই থেকে শুরু করে দেওয়ালের মেরামত সব-ই হয়েছিল আগেকার চুন-সুরকীর গাঁথতি দিয়ে - এই কাজ মোটেও সহজ ছিল না। কলকাতার নামী ঘড়ি কোম্পানি টি আর ক্লক এই ঘড়িটিকে সংস্কার করে। ২০১৬ সালে কাজ শেষ হলে এই গির্জায় আবার প্রার্থনা শুরু হয়। সেন্ট ওলাভ'স চার্চের সংস্কারের প্রজেক্টটি ২০১৬ সালে UNESCO-এর তরফে 'Asia Pacific Heritage Awards' প্রাপ্ত হয়।

এখনও এই চার্চের সামনে গেলে দেখতে পাবেন ডেনমার্কের রাজা ক্রিশ্চিয়ান দ্য সেভেনথের মনোগ্রাম এবং দেওয়ালের গায়ে ড্যানিশ ভাষায় লেখা বিভিন্ন এপিটাফ। বর্তমানে যদিও বাংলাতেই এখানে প্রার্থনা হয়। ছোটখাটো স্থানীয় congregation (ধর্মসভা) গুলিও ভারতীয় রীতিতেই পালন হয়। 

St. Olav's Church

St. Olav's Church


চার্চের ভিতর ছয়টি মার্বেল ফলক আছে - ওলি'বি, উইলিয়ম কেরী, জশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়ম ওয়ার্ড, জুলিয়ানা মারিয়া ওয়ালিচ, জেও ভয়েট (JO Voigt) - এঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। শ্রীরামপুর মিশনের স্মরণেও একটি মার্বেল ফলক আছে। 

একসময় চার্চের সামনে থেকে শুরু করে ড্যানিশ সরকারি ভবনের সামনে অবধি ছিল বাস স্ট্যান্ড। এখন সে সব উঠে গিয়েছে। চার্চের সামনে দেখতে পাবেন এক ত্রিকোণ পার্ক - ১৯৪০ সালে শ্রীরামপুরের তৎকালীন চেয়ারম্যান কানাই লাল গোস্বামী শহরের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা ড্যানিশ কামানগুলিকে একত্র করে এই পার্কে সংরক্ষণ করেন। বলা রাখা ভালো, শ্রীরামপুরে ড্যানিশদের ফৌজি উপনিবেশ ছিল না, তাই এই কামানগুলির ব্যবহার হত শুধু বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময়।



সিনেমাতেও এসেছে এই চার্চের কথা। 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' (পরে 'জাতিস্মর'-এ) সিনেমায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে কবি গানের আসরে কালীভক্ত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি-র উদ্দেশ্যে ভোলা ময়রা গেয়েছিলেন - "তুই জাত ফিরিঙ্গি জবরজঙ্গী/ পারবে না মা ত্বরাতে/ তোকে পারবে না মা ত্বরাতে/ শোনরে ভ্রষ্ট বলি স্পষ্ট, তুই রে নষ্ট মহাদুষ্ট/ তোর কি ইষ্ট কালীকেষ্ট, ভজগে যা তুই যীশুখৃষ্ট/ শ্রীরামপুরের গীর্জেতে"। এই গির্জা সেন্ট ওলাভ চার্চ-ই। অবশ্য অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ওরফে হ্যান্সম্যান অ্যান্টনি (১৭৮৬ – ১৮৩৬) সেন্ট ওলাভ চার্চে গেছিলেন কিনা তার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।

সহায়কঃ
https://www.tegnestuen-raadvad.dk/wp-content/uploads/2021/01/St.-Olav-Church-restoration-draft-26.7.2018-FAA.pdf
https://kinjalbose.com/2024/04/17/st-olavs-church-serampore/
https://www.telegraphindia.com/my-kolkata/places/churches-of-bengal-st-olavs-church-of-serampore/cid/1843561

No comments: