গৌরাঙ্গ মন্দির, কাশীশ্বর পীঠ বা কাশীশ্বর পণ্ডিতের শ্রীপাট, দোলতলা মন্দির নামেও এই মন্দিরটি পরিচিত। নামেই পরিষ্কার যে এই মন্দিরটি কাশীশ্বর পণ্ডিত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
ফ্রেডরিকনগরের দক্ষিণে মাহেশ ও বল্লভপুর আর উত্তরে চাতরা - বৈষ্ণবদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে বল্লভপুরের রাধাবল্লভ মন্দিরের স্থাপনা এই কাশীশ্বর পণ্ডিতের ভাগ্নে রুদ্ররামের হাতে৷
এই মন্দিরে দোল পার্বণ খুব ধুমধাম করে পালন হয়। তাই এর নাম দোল মন্দির বা দোলতলা মন্দির। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণমুখী সমতল ছাদ বিশিষ্ট 'কাশীশ্বর পীঠ' মন্দিরের ছাদের উপরে পূর্ব-পশ্চিমে পাশাপাশি স্থাপিত তিনটি পিরামিড আকৃতির চূড়া দেখে মনে হয়, এখানে বাস্তুশাস্ত্রের ভাষায় 'ত্রৈকুটক' রীতিতে নির্মিত পাশাপাশি ও পরস্পর-সংলগ্ন তিনটি মন্দির রয়েছে। এদের মধ্যে মাঝখানের মূল মন্দিরের চূড়াটি অপেক্ষাকৃত উঁচু। মূল মন্দিরের সামনে দরজা এবং পিছনে জানালা। দুই পাশের মন্দিরগুলির সামনে এবং পাশে দুইটি করে দরজা। মূল মন্দির থেকে পাশের মন্দিরগুলিতে যাওয়ার জন্য ভিতরে আরও একটি করে দরজা আছে। তিনটি মন্দিরের সামনে একটি বারান্দা আছে, যা অনেক পরে নির্মিত হয়েছে।
মূল মধ্য মন্দিরটি পূজার ঘর আর দুইপাশে একটি শয়ন ঘর, অন্যটি রন্ধনশালা। এই মন্দিরে অষ্টধাতু নির্মিত গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়া এবং রাধাকৃষ্ণের মূর্তি পূজিত হচ্ছেন। সেবাইতের ভুলে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের পা ভেঙ্গে যাওয়ায় তার প্রতিমূর্তি পাশে রাধারানীর সাথে সেবা হচ্ছেন। যদিও প্রাচীন মূর্তিটি বিসর্জন দেওয়া হয়নি, মাঝখানে রাখা রয়েছে। দুপাশে গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া ও রাধাকৃষ্ণের প্রতিমূর্তি বিগ্রহ আছে। এখানে গৌর মূর্তিটি অপূর্ব সুন্দর বংশীধারী বিগ্রহ। অনুমানিক ১৬৪০ সালে এই মন্দিরে বর্গীরা হানা দেয় এবং বেশ কিছু অলংকার চুরি করে নিয়ে যায়। দোল উৎসবে পৃথক দুটি রাস মঞ্চে রাধাকৃষ্ণ এবং গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার বিগ্রহকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দোলায় বসিয়ে আবির দান করা হয়। প্রচুর জনসমাগমও হয়, সামনের মাঠে মেলাও বসেএখানে দোলযাত্রা ছাড়াও রাসপূর্ণিমা, আমবারুণীতে কাশীশ্বর পণ্ডিতের জন্মােৎসব পালিত হয়।
মন্দিরের সামনে দুটি দোলমঞ্চ আছে। মন্দিরের মধ্যে একটি কুন্ড ও একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে। এখন সাপের ভয়ে এটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রবাদ আছে একসময় মন্দিরের কাছ দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হত।
গঠনশৈলীগত দিক থেকে এই তিন চূড়া বিশিষ্ট মন্দিরটি ওড়িশী বৈষ্ণব মন্দিরকলার রীতি বহন করে। ২০২০ সালে এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশন দ্বারা হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
![]() |
দোল মন্দির, চাতরা, শ্রীরামপুর (২০১৭) (ইন্টারনেট) |
এবার আসি এই মন্দিরের ইতিহাসের কথায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া এই ইতিহাস সময়ে সময়ে বিভ্রান্তকর।
১৪৫৫ শকাব্দে বা ১৫৩৩ সালে শ্রীরামপুরের চাতরায় বর্তমান চৌধুরীপাড়ায় পূর্বতন যশাের নিবাসী কাঞ্জিলাল কানুবংশদ্ভুত বাৎস্য গােত্রীয় রাঢ়ী ব্রাহ্মণ কাশীশ্বর পণ্ডিত এই গৌরাঙ্গ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের রাজউপাধি ছিল চৌধুরী। প্রভু ঈশ্বরীপাদের শিষ্য ছিলেন কাশীশ্বর পণ্ডিত। শুরু থেকেই এই মন্দিরে গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি পূজিত হত।
মতান্তরে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কাশীশ্বরের পিতা বাসুদেব ভট্টাচার্য। বাসুদেবের সময়ে এটি প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ মন্দির ছিল, পরে কাশীশ্বর এখানে গৌরাঙ্গ মূর্তি স্থাপন করেন।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) নীলাচল-পুরী যাত্রার পথে শ্রীরামপুর আসেন ১৫১০ বা ১৫১১ সালে। তাঁর উপস্থিতিতে মহা ধুমধাম করে এখানে গোপাল উৎসব পালন হয় এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার মূল ভিত্তি গঠন হয়। চৈতন্যদেব এই গৌরাঙ্গ মন্দিরটি দর্শন করেন এবং কৃষ্ণের আদলে গড়া নিজের মূর্তি দেখে অবাক হন এবং তাঁর কথামত এই মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ এর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর নির্দেশে তাঁর সেই মূর্তি তৎক্ষনাৎ গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। এর বহুবছর পরে কাশীশ্বরের পৌত্র এই মন্দিরে গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে আজও এই মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের পাশাপাশি গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি পূজিত হয়ে আসছে।
আরেকটি মত হল চৈতন্যদেব নীলাচলে যাওয়ার আগে নিজেই কাশীশ্বরকে এই গৌরাঙ্গ মূর্তিটি দিয়ে যান যাতে কাশীশ্বর চৈতন্যদেবের থেকে দূরে থাকার দু:খ ভুলে থাকতে পারেন। সেই দিক থেকে ১৫১০-১২ সালের মধ্যে এই মন্দিরটি স্থাপিত হয়।
নিমাই পণ্ডিত অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচলে চলে গেলেও কাশীশ্বর পণ্ডিত থেকে যান চাতরাতেই। ঈশ্বরীপাদের তিরোভাবের আগে উনি তাঁর দুই শিষ্য কাশীশ্বর এবং শ্রীগোবিন্দকে পুরীতে গিয়ে চৈতন্যদেবের সেবক হতে বলে যান। শ্রীগোবিন্দ আগে এবং তার কিছু পরে কাশীশ্বর পুরীতে পৌঁছান। চৈতন্যদেব নিজেও গয়াতে ঈশ্বরীপাদের থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন বলে প্রথমে গুরুভ্রাতাদের সেবা নিতে রাজি হননি। শেষে গুরুর আদেশ বলে রাজী হন। শ্রীগোবিন্দ'র উপর পড়ল প্রভুর অঙ্গসেবার দায়িত্ব। আর বলবান কাশীশ্বরের উপর পড়ল জগন্নাথ দর্শনকালে লোকের ভিড় ঠেলে প্রভুকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার ভার। বৈষ্ণবদের জনশ্রুতি যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের দুই প্রিয় সেবক ভৃঙ্গার ও ভঙ্গুর গৌরলীলায় কাশীশ্বর ও গোবিন্দ হয়ে প্রকট হয়েছিলেন।
আরেকটি মত হল, চৈতন্যদেবের মহালীলা সাঙ্গ হলে তাঁর স্মৃতিতে ১৫৩৩ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন কাশীশ্বর পণ্ডিত। ঈশ্বরীপাদের আদেশে কাশীশ্বর পুরী গিয়ে চৈতন্যদেবের সাথে থাকতে শুরু করেন।কাশীশ্বরের মাতা জাহ্নবীদেবী প্রায় ১৬ বছর পুত্রকে না দেখে জ্যেষ্ঠ পুত্র মহাদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। শেষমেষ পুরুষোত্তমধামে কাশীশ্বরের দর্শন পান। মহাপ্রভুর আদেশে মাতার সাথে দেশে ফিরে তিনি কিছুদিন বৈদ্যবাটির নিমাই তীর্থ ঘাটের কাছে পর্ণকুটির নির্মাণ করে সেখানে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজাপাঠ ও বসবাস শুরু করেন। পরে গৌড় রাজ সরকারের হুগলী দপ্তর থেকে ১০৮ টাকা বার্ষিক করে চাতরা গ্রামের জমিদারী লাভ করেন। এর কিছুদিনের মধ্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর মহা প্রয়াণের খবর আসলে তাঁর স্মৃতিতে কাশীশ্বর পন্ডিত আনুমানিক ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে চাতরায় বর্তমান চৌধুরী পাড়ায় এই গৌরাঙ্গ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
কালে কালে এই মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। জমিদারী প্রথার অবসানে অর্থাভাবে একসময় মন্দিরে নিত্যপুজো চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। শেষে স্থানীয় এবং ভক্ত জনসাধারণের চেষ্টায় ও সাহায্যে এটির সংস্কারের ব্যবস্থা সম্ভব হয়।
http://www.seramporemunicipality.net/history_feedricknagar.php
https://dailynewsreel.in/serampore-chatra-dol-mandir-feature/
No comments:
Post a Comment