Pages

Wednesday, March 08, 2023

শ্রীরামপুর - টি, সি, গোস্বামী ষ্ট্রীটের হানা হাউস

Hannah House 
38 T.C. Goswami Street
Age: 200 years+

যদি শ্রীরামপুরের শিক্ষার প্রসারে নাম আসে শ্রীরামপুর ত্রয়ী অর্থাৎ উইলিয়ম কেরি, জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়ম ওয়ার্ড, তবে নারী শিক্ষা প্রসারে যাঁর নাম অনেকেই ভুলে যাই তিনি হলেন মার্শম্যানের ধর্মপত্নী হান্না (বা হ্যানা বা হানা) মার্শম্যান (Hannah Marshman)। 

হানা মার্শম্যান (১৩ মে ১৭৬৭ - ৫ মার্চ ১৮৪৭)
© Regent's Park College, University of Oxford

১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মে উইল্টশায়ারে জন্ম হান্নার। বাবা জন শেফার্ড পেশায় চাষী, আর মা রাচেল। উইল্টশায়ারের ক্রেকারটন গীর্জার পাদ্রী ঠাকুরদা জন ক্লার্ক-এর মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই হান্নার আধ্যাত্মিক চেতনা গড়ে ওঠে। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে জশুয়া মার্শম্যানের সাথে বিবাহের তিন বছরের মাথায় ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে পৈতৃক শহর  ছেড়ে ব্রিস্টেলের ব্রোড মীড ব্যাপিস্ট চার্চে যোগ দেন হ্যান্না মার্শম্যান। 

১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে মে এই মার্শম্যান দম্পতি তাঁদের দুই সন্তানকে নিয়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে পোর্টস মাউথ বন্দর থেকে ক্রাইটোরিয়ান নামক এক জাহাজে চড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১৭৯৯-এর ১৩ ই অক্টোবর তাঁরা ড্যানিশ শাসিত শ্রীরামপুরে এসে পৌঁছান। যোগ দেন কেরী সাহেবের সাথে, তাঁর বিপুল কর্মোদ্যোগে। শ্রীরামপুর ত্রয়ীর সাহায্যে হান্না মার্শম্যান ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা মে মার্শম্যান দম্পত্তি এই শ্রীরামপুরের বুকে খুলে ফেলেন একটা নয় দু-দুটো আবাসিক বিদ্যালয়। যথারীতি এই বিদ্যালয়গুলি সেভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেনি কারন, একেই সেকালের রক্ষণশীল সমাজে নারী শিক্ষার প্রচলন সেভাবে ছিল না আর তার উপর এটি ছিল খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত এক বিদ্যালয়। মার্শম্যান-পুত্র জন ক্লার্ক ম্যার্শম্যান এই বিদ্যালয়েই শিক্ষা লাভ করে দ্রুত বাংলা বলতেও শিখে যান, যা ছিল এই বিদ্যালয়ের এক অন্যতম সাফল্য। চরম অবহেলায় বড় হয়ে ওঠা উইলিয়াম কেরী সাহেবের চার পুত্রের দায়িত্ব নিয়ে মার্শম্যান দম্পতি তাদেরকেও এই স্কুলে ভর্তি করেন। তারাও খুব তাড়াতাড়ি মিশনারী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। 

১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চার্টার অ্যাক্ট পুনরায় প্রবর্তনের সময় সাক্ষ্য দান করে হ্যানা মার্শম্যান এ দেশে শিক্ষার প্রশাসনিক ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। এই চার্টার আইনমতে ভারতবর্ষে মিশনারিদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮১৮ সালে কলকাতায় 'স্কুল সোসাইটি' স্থাপিত হলে নারী শিক্ষা বিস্তার প্রসঙ্গে প্রথম ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। ১৮১৯ সালে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে 'ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি' গঠন করা হল। দেশের রাজধানীতে যখন এই নিয়ে চর্চা চলছে তখনই ১৮১৮ সালে হুগলীর শ্রীরামপুরে হ্যানা মার্শম্যান স্থাপন করলেন প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। এর আগে এই বিদ্যালয়গুলোর কোন পাকা স্থায়ী ভবন ছিল না, বেশিরভাগ সময়েই এগুলো বসত কখনও কোন গাছের তলায় আবার কখনও বা কোন খ্রিষ্টান মিশনারির বাড়িতে। এই সমস্যা মেটানোর জন্যই একটা স্থায়ী বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অবশেষে শ্রীরামপুর শহরের গঙ্গার ধারের মনোরম পরিবেশে ইউরোপীয় গঠন শৈলীতে নির্মিত হয় এক তলার এক বিদ্যালয় ভবন।

হানা হাউস (সূত্রঃ ইন্টারনেট)

১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর ত্রয়ী শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন করলে পিছনে থেকে পুরো সাহায্য করেন হান্না। তখন তিনি কলেজের ছাপাখানার দায়িত্বে ছিলেন।তাঁর উদ্যোগে ১৮১৮-২৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উত্তর ও মধ্য ভারতে গড়ে ওঠে প্রায় ৩৩টা বিদ্যালয়। শুধু শ্রীরামপুরেই তাঁদের উদ্যোগে চালু হয় প্রায় বারো থেকে তেরোটা বিদ্যালয়। এই সমস্ত বিদ্যালয় গুলোতে নিয়মিত বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হত এবং সফল ছাত্রীদের কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে পুরস্কৃত করাও হত। ১২৩০ বঙ্গাব্দের ৩০শে চৈত্র 'সমাচার দর্পণ' সংবাদপত্রেও বিদ্যালয় ও পরীক্ষার উল্লেখ রয়েছে,

“পরীক্ষা-৫ই এপ্রিল (১৮২৪) সােমবার দিবা দশ ঘন্টার সময় শহর শ্রীরামপুরের কাছারি বাটীর সম্মুখস্থ বাবু গােপাল মল্লিকের বাটীতে শ্রীরামপুরের ও চতুর্দিকস্থ গ্রামের পাঠশালার বালিকাদের বিদ্যার পরীক্ষা হইয়াছে তাহাতে সাহেব লােক ও বিবি লােক অনেক আসিয়াছিলেন। ঐ স্থানে তেরটা পাঠশালার সর্বমোট দুই শত ত্রিশ বালিকা একত্র হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে পঞ্চাশ জন শব্দ-পাঠ করিল ও পয়ত্রিশ জন নানাপ্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তক পাঠ করিয়া সকলকে পরমাপ্যায়িত করিল ও অবশিষ্ট বালিকারা ফলা বানান ইত্যাদি পড়িল। পরে বিবি মার্সমন উঠিয়া বালিকাদিগকে বস্ত্র ও শিকি ও পরসা ও ছবি ইত্যাদি পারিতোষিক দিলেন। অপর সকলে সন্দেশ পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। দুই প্রহরের পরে পরীক্ষা সমাপ্ত হইলে রিবরেণ্ড শ্ৰীযুক্ত জন মাক সাহেব ঐ সকল পাঠশালার বিবরণ পাঠ করিলেন তাহা শুনিয়া সাহেব লােকেরা তুষ্টি হইল। আবার বালিকারা যে সকল শিল্প কর্ম অর্থাৎ মােজা ও রুমাল ও থলিয়া প্রভৃতি প্রস্তুত করিয়াছিল তাহা দেখিয়া সকলে অধিক সন্তুষ্ট হইলেন।”

১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই এপ্রিল 'ক্রিস্টান রেজিস্টার' নামক এক আমেরিকান সংবাদপত্রে এই বিদ্যালয় গুলির পরিচালন সংক্রান্ত বিবরণীও প্রকাশিত হয়। ক্রমে ক্রমে শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি সমাচার দর্পণ ও ফ্রেন্ড অফ ইণ্ডিয়া নাম পত্রিকার সম্পাদনা, ভারতীয় রেল ও শিক্ষা বিষয়ক অনুসন্ধান ও কার্যকারী প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে এই হ্যানা মার্শম্যান নিজের দক্ষতার পরিচয় রাখেন। শুধু তাই-ই নয়, প্রবল প্রতিভাধর এই মহিলাটি বাংলা, হিন্দি, ফরাসী ও সংস্কৃত ভাষায় দ্রুত ব্যুৎপত্তি অর্জন করে রচনা করে ফেলেন দুই খন্ডে ভারতবর্ষের ইতিহাস, পুনরাবৃত্তের সংক্ষিপ্ত বিবরনী, জ্যোতিষগোলাধ্যায়, ইশপ্স ফেবলস, মরিচ গ্রামার সহ আইন বিষয়ে প্রায় এক ডজন গ্রন্থ। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি নিজের মত করে ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য কাজ করে গিয়েছেন। 

এই স্কুলগুলি স্থানীয় নিম্নবিত্ত ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সমাজের পরিবারের মধ্যে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এই স্কুলগুলিকে নিচু চোখেই দেখা হত। অধিকাংশ সময়ই এগুলি ছিল অবৈতনিক, তার উপরে বাইরে থেকে তেমন সাহায্যও আসতোনা। তাই স্কুলগুলির অর্থনৈতিক সংগঠন খুব একটা ভাল ছিল না। ১৮৩৭ সালে জোশুয়া মার্শম্যানের প্রয়াণ হলে হ্যানা মার্শম্যান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পরেন, এবং তাঁর মৃত্যুর কিছু বছরের মধ্যেই স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যায়।

প্রায় আশি বছর পরে ১৯২৭ সালে যশস্বী শিক্ষাব্রতী স্যামুয়েল বোস স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় ওই পুরোনো বাড়ি এবং নতুন জমি নিয়ে 'শ্রীরামপুর মিশন গালর্স হাইস্কুল' চালু করেন। হ্যানা মার্শম্যানের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ওই পুরোনো বাড়িটিকে 'Hannah House' নামে নামকরণ করেন। বাড়িটির খুব খারাপ অবস্থা হওয়ায় কিছু সময় চলার পর তাতে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু পাশে নতুন বাড়িতে স্কুল চলতে থাকে। বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীন।

আজকের হানা হাউস - দেখলে হানাবাড়ি বা Haunted Place-ই লাগবে

কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ডেনমার্ক-এর প্রতিনিধি দল শ্রীরামপুর কলেজে সংরক্ষিত পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বাড়িটি আবিষ্কার করেন এবং বাড়িটির সংস্কারের সুপারিশ করা হয়।

যদিও সেই সংস্কারের কাজ কিছুই শুরু হয়নি। বরং ২০২৪ সালে পুরসভার কিছু লোক এসে জেসিবি দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে বাড়ির সামনের অংশ। স্থানীয় মানুষ এসে বাঁধা না দিলে সেদিনই বোধহয় শেষদিন ছিল হানা হাউসের। এখন পুরসভা থেকে সংস্কারের কথা চলছে, তবে কবে হবে কেউই জানেন না।


তথ্যসূত্রঃ

https://dailynewsreel.in/serampore-mission-girls-high-school-feature/

সাবেকি'র ফেসবুক পেজঃ https://www.facebook.com/sabekiitihas/posts/pfbid02BkYuL6sayfZCqbek7CVbhuWtbhgCtDPCamngXLi4jZs2FTLZQhAX4L8nUZsoFv2Ul

ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক'র ফেবু পেজঃ https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/posts/3857953557630269/

পুরোনো কলকাতার হারানো ঐতিহ্য'র ফেবু পেজঃ https://www.facebook.com/Kushal.writting20/posts/pfbid02kC2ErRom66HGQtQPcrLnZWtPqxQiDo8puX496dUSMtWd9nNyUQVsZBRWZdtkmi2Ul

No comments: