২০১৮ সালে শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটি পুরোনো ভাঙ্গাবাড়ি সংস্কার হয়ে ড্যানিশ ট্রাভর্ন বলে একটা নতুন হোটেল এবং রেস্তোরাঁ খোলে শ্রীরামপুরে। প্রথমে কিছুদিন রাজ্য ট্যুরিজম বোর্ড এটিকে চালালেও পরে এটিকে পরিচালনার দায়িত্ব আসে পার্ক হোটেলের হাতে। ঐতিহাসিক ড্যানিশ ট্রাভর্নের হাত ধরে রাজ্যের ফুড-মানচিত্রে শ্রীরামপুর স্থান দখল করে নেয়। খাওয়ার সাথেই আসে ঘোরা। ইতিহাস প্রেমী হন বা না হন শ্রীরামপুর এলে দারুণ দারুণ দেখার জায়গাগুলো মিস করবেন না। কে জানে ক'বছর পর এসব আর তাদের জায়গায় থাকবে কি না!
ব্যারাকপুরের বাসিন্দা হওয়ায় বহুবার ধোবিঘাটে এসে ওপাড়ের শ্রীরামপুরের গীর্জার চূঁড়া দেখেছি। কিন্তু তার তাৎপর্য বা ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে কোনদিন ভাবিনি। যাইহোক ঘুরতে যাওয়ার আগে একটু ইন্টারনেট সার্চ করতেই যা বুঝলাম ইতিহাসের খনি লুকিয়ে আছে গঙ্গার ওপাড়ে।
গঙ্গার এই পাড়ে ব্যারাকপুর আর উল্টোপাড়ে শ্রীরামপুর, চন্দননগর, চুঁচুড়া আর ব্যান্ডেল - এই পাঁচটি শহর ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশ - এবং এই অঞ্চলটিকে বলা হত - লিটল ইউরোপ।
ড্যানিশরা ভারতে পা রাখে ১৬১৮ সাল নাগাদ, বিভিন্ন ইউরোপীয়ান ব্যবসায়ীদের তারা এসে পৌঁছায় মাদ্রাজে। ১৬২০ সালের নভেম্বরে ড্যানিশ ক্যাপ্টেন Ove Gjedde পণ্ডিচেরি থেকে ১২০ কি.মি. দক্ষিণে ট্র্যাঙ্কুবারে (বর্তমান নাম থারাংগম্বাডি) ভারতে প্রথম ড্যানিশ পোস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ড্যানিশরা বাংলায় প্রথম আসে ১৬৭৬ এর দিকে কিন্তু প্রথম ড্যানিশ কলোনি গড়ে ওঠে আরো পরে, ১৬৯৮ সালে গোণ্ডলপাড়ায় - ফ্রেঞ্চ কলোনি চন্দননগরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে - এক্ষেত্রে ড্যানিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি মোগল সম্রাট আজিম-উস-সান (আওরাঙ্গজেবের নাতি)-এর থেকে ব্যবসার জন্য অনুমতি নিয়েছিল। ১৭১৪ সাল নাগাদ ড্যানিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে বিদায় নেয়, কিন্তু কিছু ড্যানিশ ব্যবসায়ী ফরাসিদের চন্দননগরকে কেন্দ্র করে তখনো এই অঞ্চলে ব্যবসা চালিয়ে যায়। কারণ ইউরোপীয় রাজনীতিতে ডেনমার্ক ছিল নিরপেক্ষ, এর ফলে ড্যানিশদের সাথে ইংরেজদের তথা ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ভাল সম্পর্ক ছিল। ১৭৩০ সাল নাগাদ ড্যানিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি (Ostindisk Kompagni) বিলুপ্ত হয়ে ড্যানিশ এশিয়াটিক কোম্পানি (Asiatisk Kompagni) তৈরি হয়।
১৭৫৫ সালে বাংলার নবাব আলিবর্দী খান (জন্ম ১৬৭১, রাজত্বকাল ১৭৪০-১৭৫৬) একটি ফরমান দেন, যার সুবাদে ড্যানিশ এশিয়াটিক কোম্পানি শ্রীরামপুরে একটি ট্রেডিং পোস্টের সূচনা করে। ড্যানিশরা সরকারি ভাবে ৮ই অক্টোবর, ১৭৫৫ থেকে এই অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করে। এই এলাকাই কিছুদিনের মধ্যে দিনেমারডাঙ্গা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই ফরমান পেতে ফরাসিরা ড্যানিশদের সাহায্য করেছিল। এই ফরমানের জন্য ড্যানিশ এশিয়াটিক কোম্পানীর খরচা হয়েছিল আনুমানিকভাবে দেড় লাখ টাকা। ১৭৫৭ সাল নাগাদ ড্যানিশরা শ্রীপুর, আকনা, গোপীনাথপুর, মোহনপুর ও পেয়ারাপুর এই পাঁচ গ্রাম নিয়ে যে শহর গঠন করে, ডেনমার্কের তৎকালীন রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের (জন্ম ১৭২৩, রাজত্বকাল ১৭৪৬-১৭৬৬) নামে তার নাম দেয় ফ্রেডরিকনগর। দিনেমার বা ড্যানিশরা এই জায়গার ইজারা বাবদ শেওড়াফুলি-রাজকে প্রতি বছর ১৬০১ সিক্কা টাকা খাজনা দিত। ১৭৭০ সাল অবধি এই এলাকায় খুব বেশি নগরায়ণ হয়নি - চারদিকে বেশির ভাগ জমিই ছিল চাষের জমি এবং ড্যানিশরাও মাটির বাড়িতেই থাকত।
আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩)-এর পরবর্তী সময়ে শ্রীরামপুরের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শুরু হয়। সেই সময়ে ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তাতে ডেনমার্ক নিরপেক্ষ থাকায় অনেক ইংরেজ, ফরাসী এবং ডাচ এখানে আশ্রয় নেয়। এবং ড্যানিশরা তাদের জাহাজে করে এদের মালপত্র ইউরোপে বহন করে নিয়ে যেতে শুরু করে। এই সময়ে অনেক দেশীয় ব্যবসায়ী, তাঁতশিল্পী এবং কারিগরেরাও শ্রীরামপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। এদের অনেকেই ডেন-দের সাথে ব্যবসা করে প্রভূত টাকাপয়সা উপার্জন করেন। ১৮০০ সাল নাগাদ শ্রীরামপুরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারেরও বেশি। এই সময় থেকেই ক্রীশ্চান ব্যাপ্টিস্ট মিশন শ্রীরামপুরে ধর্মপ্রচার শুরু করেন (এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত বলব শ্রীরামপুর কলেজ নিয়ে)। নেপোলিয়নের যুদ্ধের (১৮০৩-১৮১৫) পর ড্যানিশদের ব্যবসা বাণিজ্য ভীষণরকম ভাবে ধাক্কা খায়। ইংরেজরা ১৮০৮ থেকে ১৮১৫ অবধি ড্যানিশদের সরিয়ে শ্রীরামপুরের দখল নেয়। ১৮১৫ সালে ড্যানিশরা আবার ক্ষমতায় এলেও সারা ভারতব্যাপী ইংরেজদের আধিপত্যে আর কামড় বসাতে পারেনি।
১৮৪৫ সালে ড্যানিশরা শ্রীরামপুরকে ইংরেজদেরকে বিক্রি করে দেয়। তখন ইংরেজদের রাজধানী ছিল কলিকাতা, ফলে সদ্য অধিকৃত এই ড্যানিশ কলোনিকে নিয়ে ইংরেজ সরকার বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। যদিও শ্রীরামপুর মহকুমা ইংরেজ আমলেই ১৮৪৭ সালে তৈরি হয় এবং ১৮৬৫ সালে তৈরি হয় শ্রীরামপুর পুরসভা।
শ্রীরামপুর নামকরণ মোটামুটি দুশো সত্তর বছরের হলেও তার অনেক আগে থেকেই ভাগীরথীকূলবর্তী অন্যস্থানের মতােই এই জনপদও সম্পন্ন ছিল - কেবল বাহ্য সম্পদে নয়, সাংস্কৃতিক চর্চাতেও। পনেরো শতকে লেখা বিপ্রদাস পিপিলাই-এর 'মনসামঙ্গল' কাব্যে আকনা ও মাহেশ নামের উল্লেখ রয়েছে। শ্রী চৈতন্যের সমকালীন পুঁথিতে এই দুটি নাম ছাড়াও চাতরার উল্লেখ পাওয়া যায়। টেভার্নিয়ার-এর ভ্রমণবৃত্তান্তে মাহেশের রথযাত্রার বিবরণ রয়েছে। আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে রাজা মানসিংহের পূর্ব-ভারতে আগমন (১৫৮৯-৯০ খ্রিস্টাব্দ) ও শ্রীপুরে শিবির স্থাপনের বৃত্তান্ত থেকে এবং আবদুল হামিদ লাহোরির 'পাদশাহনামা'য় শ্রীপুরকে 'শ্রীরামপুর' নামে চিহ্নিতকরণ থেকেও অনুমান করা যায় যে, মুঘল আমলের আগে থেকেই উল্লিখিত স্থানগুলি প্রসিদ্ধি ছিল। পনেরো শতকে চৈতন্যের বৈষ্ণববাদের প্রভাবে এখানকার কয়েকটি স্থান হিন্দুদের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শ্রীরামপুরকে সেই ইতিহাসের সাথে মেলানো যাবে না। কলকাতা থেকে ২৫ কিমি দূরের শ্রীরামপুর আর-একটা পুরোনো মফস্বল শহরের মতোই ঘিঞ্জি, এক গুচ্ছ হাইরাইজ গঙ্গার ধারে বোকার মত দাঁড়িয়ে, নোংরা রাস্তাঘাট এবং সরু গলিতে ভর্তি। কয়েক বছর আগেও শ্রীরামপুরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে কারো কোন হেলদোল ছিল না।
২০০৬-০৮ সাল নাগাদ ডেনমার্ক সরকার এবং ওদেশের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাদের পুরনো কলোনি শ্রীরামপুরকে নতুন করে সাজাতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশনও এই 'শ্রীরামপুর ইনিশিয়েটিভ' এ যোগ দেয়। তার-ই ফলস্বরূপ ড্যানিশ ট্র্যাভের্ন, সেন্ট ওলাভ চার্চ, ড্যানিশ গভর্ণমেন্ট হাউস, নর্থ গেট, সাউথ গেট - ইত্যাদির আমূল সংস্কার হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো সেন্ট ওলাভ চার্চের সংস্কারের কাজকে Asia-Pacific Awards for Cultural Heritage Conservation সম্মানে ভূষিত করে।
এই প্রসঙ্গে বলা ভালো যে শ্রীরামপুরের Heritage Restoration নিয়ে যেটুকু কাজ হচ্ছে, তা মূলত ড্যানিশদের বানানো বাড়িগুলো নিয়ে। শ্রীরামপুরের ইতিহাসকে ভাগ করা যায় - ড্যানিশ-পূর্ব শ্রীরামপুর এবং বৈষ্ণব ধর্মের জনপ্রিয়তা (১৭৫৫ এর আগে), ড্যানিশ উপনিবেশ শ্রীরামপুর, ড্যানিশদের সমসাময়িক বাঙ্গালী কালচার (১৭৫৫-১৮৪৫), ড্যানিশ পরবর্তী ব্রিটিশ দখল ও শিল্পায়ন (১৮৪৫-১৯৪৭) এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়। কালের স্রোতে অনেক পুরোনো বাড়ি, স্থাপত্য, রাস্তা আজ ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে হারিয়ে গেছে।
হেরিটেজ ওয়াকে কি কি দেখবেন এই ধারাবাহিক পোস্টে লেখা রইল।