বাঙ্গিহাটি জায়গাটি শ্রীরামপুরের একদম পশ্চিম প্রান্তে, দিল্লী রোডের অন্যপাড়ে। এখানেই আছে ১২টি শিব মন্দির। শ্রীরামপুর স্টেশন থেকে অটো বা টোটো করে অথবা ডানকুনি থেকে দিল্লি রোড ধরে এখানে মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
মন্দিরের দরজায় লেখা আছে যে মন্দিরগুলি ১৭২৪ শকাব্দে স্থাপিত হয়। তার মানে ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দ।
মন্দিরগুলো নিয়ে যে গল্প শুনতে পাওয়া যায় তা হল - জমিদার রুদ্রপ্রসাদ চৌধুরী ছিলেন নি:সন্তান, তাই গঙ্গা দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন কাশীধামে, বাবা বিশ্বনাথের কাছে আশীর্বাদ নিতে। রাতের বিশ্রাম নিতে নৌকা থামল শ্রীরামপুর-শেওড়াফুলীর কোন এক ঘাটে আর ঘুমের মধ্যে জমিদারবাবু পেলেন স্বপ্নাদেশ। স্বপ্নে বাবা বিশ্বনাথ বললেন যে কাশী না এসে বাঙ্গিহাটিতে দ্বাদশ শিব মন্দির গড়ে তুলতে এবং আড়িয়াদহ নিবাসী সৎ ব্রাহ্মণ দীননাথ মুখোপাধ্যায়কে এই মন্দিরগুলির পূজার দায়িত্ব দিতে। তাই মত পরদিন জমিদার বাবু বাঙ্গিহাটি এসে মন্দিরের জন্য জমি খুঁজতে বের হলেন।
![]() |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় জমিদারবাবুর গাড়ি গেল আটকে - সেই জায়গাটিকেই শুভ বলে মনে করা হল - মন্দির প্রাঙ্গণ গড়ে উঠল সেইখানেই। স্বপ্নাদেশ মত আড়িয়াদহ থেকে আনা হল দীননাথবাবুকে। মুখ্য সেবাইত হলেন তিনি। রুদ্রপ্রসাদবাবু দীননাথবাবুকে সংলগ্ন বেশ কিছু জমিও দান করলেন, 'চক্রবর্তী' উপাধিও দিলেন। এরপর থেকে দীননাথবাবুর উদ্যোগে এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। ওনার পরবর্তী প্রজন্মই শুরু থেকে আজ অবধি এখানে কুলপুরোহিত থেকে গেছেন। এর পর থেকে রুদ্রবাবুর ব্যাপারে আরকিছু জানা যায় না।
![]() |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির - কষ্টিপাথরের শিব লিঙ্গ |
প্রশ্ন হচ্ছে রুদ্রপ্রসাদবাবু কোথাকার জমিদার ছিলেন সে ব্যাপারে কোথাও কিছু লেখা নেই। তবে কাশী যখন যাচ্ছিলেন আর মাঝ রাস্তায় শ্রীরামপুর পড়ল, ধরে নেওয়া যায় আরো দক্ষিণের কোথাও ওনার জমিদারি ছিল। কেউ মনে করেন কোন্নগরের জমিদার ছিলেন রুদ্রপ্রসাদবাবু। দ্বিতীয়ত তখন এই জঙ্গলের মধ্যে মন্দির স্থাপনের কাজ কবে শুরু, কবে শেষ সে ব্যাপারেও কেউ বিশেষ জানেননা। এই মন্দির স্থাপনের পর রুদ্রবাবুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছিল কি না তাও জানা নেই।
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
বাঙ্গিহাটির দ্বাদশ শিব মন্দির |
হতেও পারে যে এই মন্দিরগুলির কয়েকটি বা সবক'টিই আগে থেকে ছিল, রুদ্রবাবু গিয়ে শুরু খুঁজে বের করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করেন। ১৮০২ সাল থেকে ধরলে হয় মাত্র ২২২ বছর। অনেকেই মনে করেন এই দ্বাদশ মন্দিরের ইতিহাস ৫০০ বছরেরও বেশি। যদিও তথ্যপ্রমাণ কিছু নেই।
মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলি সুদূর রাজস্থানের জয়পুর থেকে আনা কষ্টিপাথরের। এবং প্রত্যেকটি শিবলিঙ্গ উত্তরমুখী। লক্ষ্য করলে দেখা যায় মন্দিরের ইটগুলো বড় থেকে ছোট আবার ছোট থেকে বড় করে কলসীর ধাঁচ দেওয়া হয়েছে। শামুকের খোল থেকে চুন তৈরী করে ব্যবহার হয়েছে এই মন্দিরে। দরজাগুলো সেগুন কাঠের তৈরী। U-আকৃতির তিন সারিতে রয়েছে ১২ টি মন্দির। মাঝে বাগান, কুঁয়ো।
সময়ের সাথে সাথে মন্দিরগুলির অবস্থা হয়ে পড়েছিল বেশ খারাপ। ১৯৭৮ সালে (বাংলা ১৩৮৫) দীননাথবাবুর উত্তরপুরুষ মন্দিরের তৎকালীন সেবাইত তথা রাজ্যধরপুর এলাকার প্রধান ডাঃ কালীদাস চক্রবর্তী মহাশয় কয়েকটি মন্দিরের সংস্কার করেন। সেই বছরেই কোন্নগরের শকুন্তলা কালীপুজোর দিনে তিনি এই মন্দিরগুলির পাশে একটি আনন্দময়ী মা (দক্ষিণাকালী)-এর মন্দির স্থাপন করেন। কথিত আছে যে একবার নাকি একটি ছোট্ট শ্যামবর্ণা, এলোকেশী এবং লাল পারের শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ে তাঁর স্বপ্নে এসে মা আনন্দময়ীর মন্দির স্থাপন করে মায়ের আরাধনা করতে বলে। শকুন্তলা কালীপুজোর দিনে এখানে বাৎসরিক পুজো হয়। যদিও এর আগেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে (বাংলা ১৩৮১) দোলপূর্ণিমার দিন এখানে রাধা গোবিন্দ জীউ-এর মূর্তি স্থাপন করেছিলেন।
মা আনন্দময়ী |
পরবর্তীকালে চক্রবর্তী পরিবার মন্দির সংলগ্ন বেশকিছু জমি মন্দিরের জন্য দান করেন, সেখানে এখন একটি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি দাতব্য চিকিতসালয় চলে। পাশে দুর্গামণ্ডপ সহ একটি ক্লাবও আছে।
এত পুরোনো, এবং এতগুলি মন্দির কেন হেরিটেজ তকমা পেল না, এই নিয়ে এখনকার সেবায়েত এবং গ্রামবাসীর মধ্যে ক্ষোভ আছে। হেরিটেজ তকমা পেলে সেই ফাণ্ড দিয়ে মন্দিরগুলিকে আরো ভাল ভাবে রাখা যেত।
No comments:
Post a Comment