Monday, December 30, 2024
Fast Charging - Know Your Tech
Thursday, December 12, 2024
Tejas Will Supply Backhaul Equipment to Vi to Increase Network Capacity
Tuesday, December 10, 2024
শ্রীরামপুর রাজবাড়ি/ গোস্বামী বাড়ি

"ধর্ম মানে আজান, ধর্ম মানে কাওয়ালি, মাইকেল এঞ্জেলোর পেইন্টিং। কত কত ফ্রেস্কোস, কত কত মন্দিরের গায়ে অসংখ্য কারুকার্য। ধর্ম মানে বাইবেল , কোরান, গীতা, ধর্ম মানে সাহিত্য, লিটারেচার। ধর্ম মানে এক কথায় আর্ট!"
শ্রীরামপুর রাজবাড়ি নিয়ে বলার আগে গোস্বামী পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া দরকার। এর সাথে সাথে দেখে নেব গোস্বামী পুরনো বাড়ি - যেখানে 'বুড়ি দূর্গা' পূজা হয়, গোস্বামীদের রাসমঞ্চ এবং রাজা কিশোরীলাল গোস্বামীর বাড়ি।
স্থানীয় মানুষ এই বাড়িটিকে শ্রীরামপুর রাজবাড়ি বললেও এটি আসলে গোস্বামীদের ঠাকুর দালান বাড়ি। অনেকে এটিকে গোস্বামী ম্যানসন বলেও থাকেন।
![]() |
গোস্বামী বাড়ির ঠাকুর দালান (২০২০) |
বলা হয় যে গৌড়ের রাজা আদিসুর বাংলায় জ্ঞানপিপাসা মেটানোর জন্য পাঁচটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে আমন্ত্রণ করে আনেন। এই পাঁচটি ব্রাহ্মণ পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারের বংশধরেরাই হলেন এই গোস্বামীরা। এই বংশেরই পাটুলী নিবাসী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্য দর্শনের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর বিয়ে হয় নদীয়ার শান্তিপুরের গোস্বামী বংশীয় দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত ভীম তর্কাপঞ্চাননের মেয়ের সাথে। এ কাহিনী অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের কথা - বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ (রাজত্বকাল ১৭৪০-১৭৫৬)।
এই ভীম তর্কাপঞ্চানন ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের পরমভক্ত অদ্বৈতাচার্য গোস্বামীর পুত্র অচ্যুত গোস্বামীর বংশধর। লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর বাড়ি বর্ধমানের পাটুলীতে হলেও তার পুত্র রামগোবিন্দ শান্তিপুরে মাতামহ পণ্ডিত ভীম তর্কাপঞ্চাননের কাছেই বড় হন। পরবর্তী সময়ে রামগোবিন্দ ভাগবতজ্ঞান লাভ করে মাতৃদত্ত গোস্বামী পদবি ব্যবহার শুরু করেন।
একদিন রামগোবিন্দ নদীপথে গঙ্গা ধরে শান্তিপুর থেকে কলিকাতা যাচ্ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী। হঠাৎ পথে প্রসব–বেদনা শুরু হলে নৌকা তীরে ভেড়ানো হয় শ্রীরামপুরে - রামগোবিন্দর স্ত্রী মনোরমা দেবী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এই সময়ে শ্রীরামপুর ছিল শেওড়াফুলির রাজাদের অধীনে এবং ঘটনাচক্রে শেওড়াফুলি ছিল পাটুলির রাজাদের কাছারি বাড়ি। শেওড়াফুলির তৎকালীন রাজা মনোহর রায় দানধ্যানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। পরম ভাগবত রামগোবিন্দের পুত্র রাধাকান্ত শ্রীরামপুরে ভূমিষ্ট হয়েছে এই খবর পেয়ে স্যাড়াপুলির রাজা মনোহর রায় (? - ১৭৪৪ খ্রীঃ) [মতান্তরে বাসুদেব রায়] গঙ্গার ধারে ঐ জমি রামগোবিন্দকে দান করতে অনুমতি চান। ব্রাহ্মণ রামগোবিন্দ সেই দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেও রাজার অনুরোধে একটি কড়ির বিনিময়ে সেই সম্পত্তি শেওড়াফুলির রাজার থেকে কিনে নেন। এই ভাবেই পাটুলীর গোস্বামী পরিবার শ্রীরামপুরে থাকা শুরু করেন। গোস্বামীদের শ্রীরামপুরে প্রথম বাড়িটিও রামগোবিন্দের আমলেই তৈরি হয়। এই বাড়িটিতেই এখন বুড়ি দূর্গা পুজো হয়।
![]() |
গোস্বামীদের আদিবাড়িতে বুড়িদুর্গা পুজো |
![]() |
বুড়ি দূর্গা পুজোর বয়স ৪১৭ বছর (২০২২ অবধি) |
রামগোবিন্দের দুই পুত্র - রামগোপাল এবং রাধাকান্ত। রাধাকান্তের দুই পুত্র - রামনারায়ণ এবং হরিনারায়ণ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিসের মাধ্যমে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' প্রথা চালু করছেন (১৭৯৩ খ্রী:), রামনারায়ণ তখন আসামের দেওয়ান। শোনা যায় গৌরীপুর, বিজনী, বসরীপাড়া প্রভৃতি জায়গার জমিদারদের সনদে রামনারায়ণের দস্তখত ছিল। রামনারায়ণের পুত্র রাজীবলোচন বর্ধমানে সমুদ্রগড়ের দেওয়ানি পদে অধিষ্ঠিত থেকে বহু অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। কলকাতার অভিজাত বাঙালী সমাজে রাজীবলোচনের বিশেষ সমাদর ছিল।
রামনারায়ণের ছোট ভাই হরিনারায়ণও কৃতিমান ছিলেন - উনি ছিলেন দিনেমারদের শুল্ক বিভাগের দেওয়ান। হরিনারায়ণ যখন দিনেমারদের দেওয়ান তখন ইংল্যান্ডের সঙ্গে ফ্রান্স ও হল্যান্ডের বাণিজ্য-যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করেছিল (১৭৮০-৮৪)। এই অবস্থায় এই সব দেশের রণতরীগুলি ব্রিটিশদের বাণিজ্যতরীগুলিকে মাঝসমুদ্রে লুঠ করতে শুরু করে। ফলে ভারত থেকে যে বিপুল পণ্যসামগ্রী ইংল্যান্ডে রপ্তানি হত তাতে ধাক্কা লাগে। এই সময়ে শ্রীরামপুরের ড্যানিশ বা দিনেমাররা চড়া দামে ব্রিটিশদের পণ্যসামগ্রী নিজেদের জাহাজে করে পৌঁছে দিতে রাজি হয়। একই সঙ্গে ব্রিটিশ প্রাইভেট ট্রেডারদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য পণ্য ও অর্জিত বা লুঠ করা সম্পদ ব্রিটিশ সরকারের চোখ এড়িয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন হত, যে কাজে ড্যানিশরা তাদের সাহায্য করত। ফলে মাত্র নয় মাসের মধ্যে দিনেমাররা অন্তত বাইশটি জাহাজে করে মোট দশ হাজার টন পণ্যসামগ্রী শ্রীরামপুর থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভূত লাভের মুখ দেখে। স্বাভাবিকভাবেই হরিনারায়ণও এই সময় বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এই সময় থেকেই গোস্বামী পরিবার শ্রীরামপুরের এক সম্মৃদ্ধ পরিবারে পরিণত হয়।
এই সময়েই গোস্বামীদের গৃহদেবতা শ্রীশ্রী রাধামাধব জীউ-এর প্রতিষ্ঠা হয় এবং গঙ্গার ধারে রাসমঞ্চ ও স্ত্রী–পুরুষের পৃথক স্নানঘাট ইত্যাদি নির্মিত হয়।
![]() |
চাঁদনি - গোস্বামীদের ঠাকুরদালান |
হরিনারায়ণের দুই পুত্র - রাঘবরাম এবং রঘুরাম (১৭৮৪-১৮৪০)। রঘুরাম ছিলেন জন পামার কোম্পানীর মুৎসুদ্দি (= হিসাবরক্ষক)। ১৮৩২ সালে জন পামার কোম্পানি উঠে গেলে বহু লোক সর্বস্বান্ত হয়। কানাঘুষোতে জানা যায় জন পামার নিজে আগে থেকে রঘুরামকে এই ঘটনার ইঙ্গিত দেওয়ায় রঘুরাম তাঁর সম্পত্তি বাঁচাতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে উনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের শেয়ারহোল্ডারও হন। ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ভরাডুবি ঘটলেও রঘুরাম কিন্তু সময়মত শেয়ার বেচে দেন। এইভাবে পরপর দু’বার তিনি ভাগ্যক্রমে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান। 'প্রিন্স অফ মার্চেন্ট' হিসেবে বিখ্যাত রঘুরাম গোস্বামী সেই সময়ে এতটাই ধনী ছিলেন যে রঘুরাম ১২ লাখ টাকা দিয়ে ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছিল ইংরেজরা। শেষমেশ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তেরো লক্ষ টাকায় ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নেয়।
![]() |
রঘুরাম গোস্বামী |
রঘুরামের সময়েই আজকের গোস্বামী ম্যানসন গড়ে ওঠে (১৮১৫-১৮২০)। শোনা যায় যে রাইটার্স বিল্ডিং এর স্থপতি টমাস লিওন এই বাড়ির নকশা বানিয়ে দিয়েছিলেন। গোস্বামী বাড়ি তৈরি হলে পরিবারের গৃহদেবতা রাধামাধব জীউ এবং গোপালজীকে এই দালানবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। সাথে নিয়ে আসা হয় অষ্টধাতুর রাধারানী মূর্তিটিও। এখনও প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরপুজো করেন পরিবারের কুলপুরোহিত।
প্রায় ৬ বিঘা জমির উপর তৈরি হওয়া এই প্রাসাদোপম ঠাকুর দালানটি ইন্দো-ইউরোপীয় ধাঁচের সুদৃশ্য খিলান সহ প্রবেশ তোরণ ও ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত।
![]() |
শ্রীরামপুর গোস্বামী ম্যানসনের দ্বিতীয় তলা (taken from Facebook) |
রঘুরামের তিন পুত্র - আত্মারাম, গঙ্গাপ্রসাদ ও গোপীকৃষ্ণ। আত্মারাম মাত্র ৫ বছর বয়সে মারা যান।
গোপীকৃষ্ণের পাঁচ পুত্র - কৃষ্ণলাল, নন্দলাল, কিশোরীলাল, রাজেন্দ্রলাল এবং রাধিকালাল।
নন্দলাল গোস্বামী ছিলেন শ্রীরামপুর পুরসভার প্রথম ভারতীয় চেয়ারম্যান (১৮৮৪-৯৩)।
গোপীকৃষ্ণ গোস্বামীর তৃতীয় পুত্র কিশোরীলাল গোস্বামী ছিলেন এক কৃতিপুরুষ। ১৮৫৬ সালে কিশোরীলালের জন্ম হয় ব্রিটিশ শ্রীরামপুরে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. এবং কলকাতার ল' কলেজ থেকে বি. এল. পাশ করে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে বেশ কিছুদিন আইন ব্যবসাও করেন।

তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং জমিদারি সভার সদস্য। মর্লে - মিন্টো শাসন সংস্কার অনুসারে বাংলার কার্যনির্বাহক পরিষদেও তিনি নিযুক্ত ছিলেন।১৯১১ সালে কলকাতায় পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক দরবারে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন এই রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী। ১৯১১ সালের পয়লা জানুয়ারিতে তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'রাজা' উপাধি প্রদান করেন। বলা বাহুল্য এর পর থেকেই গোস্বামীদের ঠাকুর দালান সহ বাড়িটি স্থানীয়মুখে রাজবাড়ি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। পরে তিনি বিভিন্ন কারণে কলকাতা ছেড়ে শ্রীরামপুরেই থিতু হন।
তাঁর অর্থানুকূল্যেই ভবেন্দ্রবালাদেবী যক্ষ্মা হাসপাতালটি তৈরি হয়।
দু:খের বিষয় হল রাজা কিশোরীলাল বেশিদিন এই বাড়িতে থাকেননি। তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন পরিবারের ভিতরে ঝামেলা বাঁধতে চলেছে। কৃষ্ণলালের সাথে তাঁর বাবা গোপীকৃষ্ণর মতবিরোধ তুমুলে ওঠে এবং কৃষ্ণলাল তাজ্যপুত্র হন। এই সময়ে কিশোরীলাল গঙ্গার ধারে নির্মাণ করছিলেন এক সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়ি। এই অবস্থায় ১৯০৮ সালে নন্দলালের মৃত্যুর পর পরিবার ভাঙ্গতে শুরু করে। ১৯১০ থেকে কিশোরীলাল তাঁর নতুন বাড়িতেই মৃত্যু (১৯২৩ খ্রী:) অবধি ছিলেন।
রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী (১৮৫৬-১৯২৩) ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে দ্বিতীয় নির্বাচিত পৌরপ্রধান (১৯০৩-১৯০৯)। তিনি ১৯১৪ সালে শ্রীরামপুরের জল সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তিনি এবং তাঁর ভাই নন্দলাল ওয়ালশ হসপিটাল ও নন্দলাল ইন্সটিটিউশন তৈরিতে অবদান রাখেন। নন্দলাল-এর পুত্র রমেশচন্দ্র - শ্রীরামপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
কিশোরীলালের পুত্র তুলসীচন্দ্র গোস্বামী (১৮৯৮-১৯৫৮) অক্সফোর্ডে আইন পড়েন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অন্যতম কাছের মানুষ ছিলেন তুলসীচন্দ্র ওরফে টিসি গোস্বামী। চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তুলসীচন্দ্র গোস্বামী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁর বয়স যখন মাত্র পঁচিশ বছর, তখন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁকে নবগঠিত স্বরাজ্য পার্টির সদস্য হিসেবে বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচনের জন্য নির্বাচিত করেন।এই বৃত্তেরই আর এক বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গেও ছিল তুলসীচন্দ্রের বিশেষ হৃদ্যতা। সেই সূত্রে সুভাষও এসেছেন এবাড়িতে। পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আইনসভায় স্বরাজ্যবাদী দলে অনেক যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তুলসীচন্দ্র গোস্বামীর থেকে মেধাবী আর কেউ ছিলেন না, ফলে উল্কার গতিতে টি.সি.-এর রাজনৈতিক উত্থান হয়। তাঁর চমৎকার সংসদীয় পারফরম্যান্স, তাঁর অতুলনীয় বাগ্মীতা, সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের তীব্র নিন্দা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
১৯৩০ সালে তুলসীচন্দ্র শ্রীরামপুরকে টাউন হল উপহার দেন, যা ছিল একসময়ে তাঁর বাবা রাজা কিশোরীলালের কাছাড়ি বাড়ি।
রাজা কিশোরীলালের পৌত্র কানাইলাল ১৯৩২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত শ্রীরামপুরের মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান ছিলেন।
শ্রীরামপুরের গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপুজোও এক জীবন্ত ইতিহাস। পরিবারের মানুষদের কাছে শোনা যায় এই পুজোয় সংগীতানুষ্ঠানে গান গেয়ে গেছেন অ্যান্টনি কবিয়াল, ভোলা ময়রা থেকে বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীরাও। এখন যদিও পুরোনো বাড়িতে মূল পুজো (বুড়ি দূর্গা) এবং নতুন বাড়ি (লোকে যাকে রাজবাড়ি বলে চেনে) - দুই জায়গাতেই দূর্গাপুজো হয়, মূল পুজো কিন্তু পুরনো বাড়ির বুড়ি দূর্গাপুজোটিই। একচালার ডাকের সাজের এই সাবেকি প্রতিমা দেখতে গোস্বামীদের আজকের প্রজন্ম তো বটেই, স্থানীয় মানুষ এবং দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। বাঁশের কুলোর মত চালচিত্রে ঘড়ির কাঁটার অনুসারে আঁকা থাকে বিভিন্ন দেবদেবী এবং অসুরদের - জয়া, পাঁচ দশাবতার (মৎস, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন), চামুণ্ডা কর্তৃক চণ্ড এবং মুণ্ড অসুর হত্যা, কৈলাসবাসী শিব,দুর্গা এবং চামুণ্ডা মিলে অসুর রক্তবীজের দমন, বাকি পাঁচ দশাবতার (পরশুরাম, রাম,কৃষ্ণ, বুদ্ধ, কল্কি) এবং সবশেষে বিজয়া।
রথযাত্রার দিন দেবীর কাঠামো পুজো দিয়ে শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের বাড়িতে পুজো শুরু হয়। বোধন হয় ষষ্ঠীতে - সেদিন ঠাকুর দালানের পাশে একটি ঘরকে শিবের বাড়ি অর্থাৎ কৈলাস পর্বত বলে সেবা করা হয় আর ঠাকুরদালান সেদিন হয়ে ওঠে দুর্গার বাপের বাড়ি। এই ঘর থেকে ঘট এনে দেবীমূর্তির পাশে রাখা হয় - অর্থাৎ মা চলে আসলেন বাপের বাড়ি। সপ্তমীর সকালে হয় 'ঘটমাল্য' - বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা সদস্য ঘটের উপর মালা দিয়ে দেবীকে বরণ করেন, যেন মা মেনকা স্বাগত জানাচ্ছেন মা দুর্গাকে। এই পুজোতে চারদিনই কুমারী পুজো হয়, তবে মহানবমীর দিন এই পুজোর জৌলুশ অন্যমাত্রা নেয়।
পুজোর দশমীর দিন বাড়ির এয়োস্ত্রী-রা ইলিশ মাছ, পান্তা ভাত ও পান খেয়ে প্রতিমাকে বরণ করেন, তারপর প্রতিমা যায় বিসর্জনে।
পুজোর জৌলুশ কমেছে এখন, মূলত স্কুলবাড়ি এবং ডিস্ট্রিক্ট এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অফিস-এর ভাড়া থেকেই এই বাড়ি এবং পুজোর খরচ ওঠে। তবে ইদানিং বিয়েবাড়ি বা প্রিওয়েডিং শুটিং-এর ভাড়া দিয়ে ভালো টাকা উঠছে বলেই মনে হয়। ২০২০ সালে আমি যখন প্রথমবার যাই, অবস্থা ছিল বেশ খারাপ, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ/ মেরামতিও হত না।
তবে এখন ফোটোশ্যুটিং-এর জন্য (প্রিওয়েডিং, মডেল ফোটোশ্যুট ইত্যাদি) রাজবাড়িটির উত্তরভাগটি নিয়মিত ভাড়া নেয় বিভিন্ন মানুষজন। সেই সুবাদে এখন একটু রংটং করে কিছুটা হলেও বাইরের রূপ ফিরেছে রাজবাড়ির। যদিও এখানে কোন প্রবেশমূল্য নেই, কিন্তু শুটিং পার্টি থাকলে দারোয়ান ঢুকতে দিতে চান না।
![]() |
বিয়েবাড়ি উপলক্ষে সেজে উঠেছে গোস্বামী বাড়ি - ১ |
![]() |
বিয়েবাড়ি উপলক্ষে সেজে উঠেছে গোস্বামী বাড়ি - ২ |
![]() |
বিয়েবাড়ি উপলক্ষে সেজে উঠেছে গোস্বামী বাড়ি - ৩ |
গোস্বামী বাড়ি বা শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দক্ষিণ অংশে একটি primary স্কুল চলে - Bunch of Flowers, সেই ১৯৬৭ সাল থেকে।
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari 2 |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari 3 |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari 4 |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari 5 |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari : Bunch of Flowers |
![]() |
Southern Part of Goswami Rajbari - Inside |
শ্রীরামপুর শহরের সামাজিক উন্নতির পিছনে গোস্বামী পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মনে রাখতে হবে ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশরা এই শহরের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই শহরের উন্নতি এসেছে জুটমিল, কটনমিল ইত্যাদি শিল্পের মাধ্যমে। একসময়কার বৈষ্ণবধর্মের পীঠস্থান এই শহর ঝিমিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই গোস্বামী পরিবারের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চাতরা নন্দলাল ইন্সটিটিউশন, রমেশচন্দ্র গার্লস স্কুল; ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য অবৈতনিক ছাত্রাবাস – রাজেন্দ্রলাল ফ্রি বোর্ডিং ফর বয়েজ, অন্নপূর্ণাদেবী ফ্রি গার্লস বোর্ডিং। শহরের জল সমস্যার সুরাহার জন্য ১৯১৩ সালে নন্দলাল গোস্বামী তৈরি করেন 'গোপীকৃষ্ণ গোস্বামী ওভারহেড ট্যাঙ্ক'।
![]() |
Water Tank by the Goswamis at N.N. Roy Street |
এমনকি বর্তমান শ্রীরামপুর পৌরসভা ভবনটিও গোস্বামী পরিবারের দান করা, সেটি আগে ছিল রাজা কিশোরীলাল গোস্বামীর কাছারিবাড়ি।
লঞ্চঘাট থেকে রাজবাড়ি আসতে আসতে চোখে পড়তে পারে গঙ্গার ধারে রাসমঞ্চ। রাজবাড়ির মতোই রাসমঞ্চ আজ উপেক্ষিত, এবং ক্ষয়িষ্ণু। দেওয়াল থেকে ইট বেরিয়ে রয়েছে, গাছ গজিয়ে রাসমঞ্চের সাতটি চূঁড়া প্রায় ঢেকে গিয়েছে। চারদিক থেকে রিয়েল এস্টেট এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে কদিন বাদে এই রাসমঞ্চ ভেঙ্গে পড়লে হয়তো বা লোক বলবে ভালোই হয়েছে।
রাসমঞ্চ, গোস্বামী বাড়ি, শ্রীরামপুর |
রাসমঞ্চ, গোস্বামী বাড়ি, শ্রীরামপুর |
রাসমঞ্চ, গোস্বামী বাড়ি, শ্রীরামপুর |
'ভূতের ভবিষ্যৎ' যারা দেখেছেন, তারা অবশ্যই মনে করতে পারবেন এই রাজবাড়িকে। 2012 সালের অনীক দত্ত-র সিনেমা গড়িয়েছিল এই বাড়িতেই থাকা ভূতেদের নিয়ে।
সত্যজিৎ রায়ও এক দিন ঘুরতে ঘুরতে হাজির হয়েছিলেন শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে - 'ঘরে বাইরে' ছবির শ্যুটিং সাইট দেখতে। শেষ অবধি তা আর হয়ে ওঠেনি।
গোস্বামীরা শ্রীরামপুরে গোস্বামী ঠাকুরবাড়ি ও গোস্বামী রাজবাড়ি সহ অনেক বাড়ি তৈরি করেন এবং সাথে নদীর তীর বরাবর অবস্থিত ইউরোপীয়দের অনেক ভবন কিনেও নেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাজা কিশোরীলালের ভাই রাজেন্দ্রলাল গোস্বামীর বাড়িটি - 'রাজেন্দ্র স্মৃতি'। আজ ধুবিঘাটের কাছে শীল বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে গঙ্গার ধারে ছিল সেই বাড়ি - আজ সে বাড়ি ইতিহাসের পাতায় - সেই বাড়ি ভেঙ্গে আজ দখল নিয়েছে বহুতল - 'গঙ্গা দর্শন'।
![]() |
রাজেন্দ্র স্মৃতি - সূত্রঃ দেবরাজ গোস্বামীর ফেসবুক পোস্ট |
আজ ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা গোস্বামীদের খুঁজে বের করা হয়ত সহজ। কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের কাজকর্ম খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। রাজা কিশোরীলাল গোস্বামীর কথা জানতে চাইলে জেমিনি সমসাময়িক হিন্দি কবি কিশোরীলালের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের এত কাছের লোক ছিলেন রাজা কিশোরীলালের পুত্র তুলসীচন্দ্র গোস্বামী। তাঁর বিভিন্ন ভাষণ/বক্তৃতা এবং লেখার সংকলন - 'Footprints of Liberty' (published by Tulsi-Beena Trust, 1971) দেশের কোথাও পাওয়া যায় না, অনলাইনে খুঁজলে লন্ডন সহ বিভিন্ন ইউরোপীয়ান লাইব্রেরির সন্ধান মেলে, কোন তাকে বইটি আছে সেও জানা যায়। হয়তো কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাতে অবহেলায় পড়ে আছে সে বই। এই বইটিতে তাঁর অন্যান্য বক্তৃতার মধ্যে, কেন্দ্রীয় এবং বাংলা আইনসভায় তাঁর বেশিরভাগ স্মরণীয় বক্তৃতা রয়েছে। এতে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধও রয়েছে, যা বেশিরভাগই তিনি রাজনীতিতে আসার আগে বা অবসর নেওয়ার পরে লিখেছিলেন।
বংশতালিকাঃ
রামগোবিন্দের দুই পুত্র - রামগোপাল এবং রাধাকান্ত (শ্রীরামপুরে জন্ম)
রামগোপালের চতুর্থ অধঃস্তন পুরুষ রামজয় গোস্বামী। তাঁর পাঁচ পুত্রের একজন অমৃত গোস্বামী। অমৃত গোস্বামীর দুই পুত্র ডাঃ গোপালচন্দ্র গোস্বামী এবং যোগীন্দ্রনাথ। যোগীন্দ্রনাথ একজন উঁচুদরের সাধক ছিলেন।
রাধাকান্তের দুই পুত্র - রামনারায়ণ এবং হরিনারায়ণ
রামনারায়ণের পুত্র রাজীবলোচন
হরিনারায়ণের পুত্র - রঘুরাম এবং রাঘবরাম (১৭৮৪-১৮৪০)
রঘুরামের তিন পুত্র - আত্মারাম, গঙ্গাপ্রসাদ ও গোপীকৃষ্ণ। আত্মারাম মাত্র ৫ বছর বয়সে মারা যান।
গোপীকৃষ্ণের পাঁচ পুত্র - কৃষ্ণলাল, নন্দলাল, কিশোরীলাল, রাজেন্দ্রলাল এবং রাধিকালাল।
নন্দলাল-এর পুত্র রমেশচন্দ্র - শ্রীরামপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। রমেশচন্দ্র-এর পুত্র ছিলেন বলাইচন্দ্র গোস্বামী।
বলাইচন্দ্র-র দুই কন্যা এবং চার পুত্র (সুনীল কুমার (অপুত্রক), নিখিল কুমার (শ্রীরামপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন), দিলীপ কুমার, শ্যাম )
রাজা কিশোরীলাল (১৮৫৬-১৯২৩) - রানী বকুলমণি দেবীর (১৮৭৪-১৯৪৬) পুত্র তুলসীচন্দ্র গোস্বামী (জন্ম ১৮৯৮-মৃত্যু ১৯৫৭), অমূল্য চন্দ্র গোস্বামী।
তুলসীচন্দ্রের কন্যা অসীমা গোস্বামী কিশোরীলালের বাড়িটিকে বিবেকানন্দ নিধিকে দান করেন।
http://www.jathaichchatathaja.com/2022/02/15/দিনেমারদের-ফ্রেডরিক-নগরে/
https://en.natmus.dk/historical-knowledge/historical-knowledge-the-world/asia/india/the-history-of-serampore/the-goswami-palace/
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/rosysingh/history-of-srirampur-rajbari-which-was-actually-the-house-of-raghuram-goswami-of-santipur-second-part/
https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/history-of-serampore-rajbarir-s-durgapuja
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/rosysingh/history-of-srirampur-rajbari-which-was-actually-the-house-of-raghuram-goswami-of-santipur-third-part/
Friday, December 06, 2024
Purulia Travel - Ajodhya Circuit
On the way to Ajodhya Hills |
পিন্দারে পলাশের বন, পালাবো পালাবো মন
পুরুলিয়াতে বেড়ানো মানে আপনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ঘুরতে হবে।
১. পুরুলিয়া শহরকে ঘিরে ভ্রমণ
২. অযোধ্যা ট্রাভেল সার্কিট এবং
৩. রঘুনাথপুর-গড়পঞ্চকোট-বড়ন্তী সার্কিট।
অনেকে বীরভূমের মুকুটমণিপুর বেড়াতে এসেও পুরুলিয়া ঘুরে যান কারণ পুরুলিয়ার ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাতেই আছে মুকুটমণিপুর ড্যাম।
-
Though I made the caption as 'REMADE', these days commercial bengali films are just mere scene-to-scene copy and paste from sout...
-
At a point you may find that 404-999 is a 3G network live at your area while you are manually setting the network. There is no name of this...
-
S erampore (Srirampur/শ্রীরামপুর) is a busy town of Hooghly district, approx. 25 km north to Kolkata, the capital city of West Bengal. Today...