শ্রীরামপুরে গোস্বামীরা ছিলেন মূলত ব্যবসায়ী, কিন্তু হঠাৎ এঁদের বাড়ি রাজবাড়ি হয়ে উঠল কি ভাবে? ইতিহাস বলছে গোস্বামীরা শ্রীরামপুরে স্থিতু হন শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়ের অনুরোধে। সেই অর্থে শেওড়াফুলির রাজার অধীনে ছিলেন গোস্বামীরা।
রঘুরাম গোস্বামীর সময়ে শ্রীরামপুরের গোস্বামী পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তুঙ্গে ওঠে। 'প্রিন্স অফ মার্চেন্ট' হিসেবে বিখ্যাত রঘুরাম গোস্বামী সেই সময়ে এতটাই ধনী ছিলেন যে রঘুরাম ১২ লাখ টাকা দিয়ে ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছিল ইংরেজরা। শেষমেশ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তেরো লক্ষ টাকায় ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নেয়।
এই রঘুরামের কনিষ্ঠ পুত্র গোপীকৃষ্ণের পাঁচ পুত্র - কৃষ্ণলাল, নন্দলাল, কিশোরীলাল, রাজেন্দ্রলাল এবং রাধিকালাল।
গোপীকৃষ্ণ গোস্বামীর তৃতীয় পুত্র কিশোরীলাল গোস্বামী ছিলেন এক কৃতিপুরুষ। ১৮৫৬ সালে কিশোরীলালের জন্ম হয় ব্রিটিশ শ্রীরামপুরে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. এবং কলকাতার ল' কলেজ থেকে বি. এল. পাশ করে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে বেশ কিছুদিন আইন ব্যবসাও করেন।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং জমিদারি সভার সদস্য। মর্লে - মিন্টো শাসন সংস্কার অনুসারে বাংলার কার্যনির্বাহক পরিষদেও তিনি নিযুক্ত ছিলেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক দরবারে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন এই রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী। ১৯১১ সালের পয়লা জানুয়ারিতে তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'রাজা' উপাধি প্রদান করেন। বলা বাহুল্য, এর পর থেকেই গোস্বামীদের ঠাকুর দালান সহ বাড়িটি স্থানীয়মুখে রাজবাড়ি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
পরে তিনি বিভিন্ন কারণে কলকাতা ছেড়ে শ্রীরামপুরেই থিতু হন। তাঁর অর্থানুকূল্যেই ভবেন্দ্রবালাদেবী যক্ষ্মা হাসপাতালটি তৈরি হয়।
দু:খের বিষয় হল রাজা কিশোরীলাল বেশিদিন এই বাড়িতে থাকেননি। তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন পরিবারের ভিতরে ঝামেলা বাঁধতে চলেছে। কৃষ্ণলালের সাথে তাঁর বাবা গোপীকৃষ্ণর মতবিরোধ তুমুলে ওঠে এবং কৃষ্ণলাল তাজ্যপুত্র হন। এই সময়ে কিশোরীলাল গঙ্গার ধারে নির্মাণ করছিলেন এক সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়ি। এই অবস্থায় ১৯০৮ সালে নন্দলালের মৃত্যুর পর পরিবার ভাঙ্গতে শুরু করে। ১৯১০ থেকে কিশোরীলাল তাঁর নতুন বাড়িতেই মৃত্যু (১৯২৩ খ্রী:) অবধি ছিলেন।
![]() |
বারাকপুর থেকে গঙ্গা পেরিয়ে আসতে দেখা যায় রাজা কিশোরীলালের বাড়ি |
![]() |
রাজা কিশোরীলালের বাড়ি |
![]() |
রাজা কিশোরীলালের বাড়ি |
![]() |
মেন গেটের উপরে সম্ভবত গেট-ল্যাম্প |
![]() |
দারোয়ানের ঘর - রাজা কিশোরীলালের বাড়ি |
![]() |
রাজা কিশোরীলালের বাড়ি |
বর্তমানে এই বাড়িটি 'বিবেকানন্দ নিধি'র অধীনে। শোনা যায় যে কিশোরীলালের নাতনি, তুলসীচন্দ্রের কন্যা অসীমা গোস্বামী ভুলবশত এই বাড়িটিকে বিবেকানন্দ নিধি'কে দান করেন। উনি ভেবেছিলেন যে এই সংস্থা বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনেরই অংশ। এখন এই বাড়ি নিয়ে গোস্বামী পরিবার এবং এই সংস্থার কোর্টে কেস চলছে।
এই বাড়ির পিছনের দিকে আরও কিছু জমি অসীমা গোস্বামী দান করে গেছিলেন। ১১/১ রাজা কে.এল. গোস্বামী স্ট্রীটে এখন ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনায় চলছে রাণী বকুলমণি নিশান্ত নিবাস এবং গোবিন্দাশ্রম মাতৃ মন্দির।
রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী (১৮৫৬-১৯২৩) ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম নির্বাচিত পৌরপ্রধান। তিনি ১৯১৪ সালে শ্রীরামপুরের জল সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তিনি এবং তাঁর ভাই নন্দলাল ওয়ালশ হসপিটাল ও নন্দলাল ইন্সটিটিউশন তৈরিতে অবদান রাখেন।
রাজা কিশোরীলালের বিবাহ হয় বকুলমণি দেবীর সাথে - তাঁদের তিন পুত্র - অমূল্য চন্দ্র, পূর্ণচন্দ্র এবং তুলসী চন্দ্র এবং কন্যা - সরলা।
![]() |
রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী এবং তাঁর সহধর্মিণী রাণী বকুলমণী দেবী |
কিশোরীলালের পুত্র তুলসীচন্দ্র গোস্বামী (১৮৯৮-১৯৫৮) অক্সফোর্ডে আইন পড়েন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অন্যতম কাছের মানুষ ছিলেন তুলসীচন্দ্র ওরফে টিসি গোস্বামী। চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তুলসীচন্দ্র গোস্বামী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁর বয়স যখন মাত্র পঁচিশ বছর, তখন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁকে নবগঠিত স্বরাজ্য পার্টির সদস্য হিসেবে বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচনের জন্য নির্বাচিত করেন।এই বৃত্তেরই আর এক বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গেও ছিল তুলসীচন্দ্রের বিশেষ হৃদ্যতা। পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আইনসভায় স্বরাজ্যবাদী দলে অনেক যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তুলসীচন্দ্র গোস্বামীর থেকে মেধাবী আর কেউ ছিলেন না, ফলে উল্কার গতিতে টি.সি.-এর রাজনৈতিক উত্থান হয়। তাঁর চমৎকার সংসদীয় পারফরম্যান্স, তাঁর অতুলনীয় বাগ্মীতা, সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের তীব্র নিন্দা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
এখন কথা হচ্ছে যে আমাদের ছোটবেলার পাঠ্য ইতিহাস বইতে এঁদের নাম নেই। এবং সেই সমকালীন ইতিহাসে এঁনাদের কার্যকলাপ-ও বিশেষভাবে জানা যায় না। কেন? তার উত্তর নেই।
কিশোরীলালের কন্যা সরলাদেবীর সাথে বিবাহ হয় পাবনার জমিদার এবং তৎকালীন জাতীয় আন্দোলনের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর সাথে। সরলা-যোগেন্দ্রনাথের পুত্র কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র ওরফে প্রখ্যাত বামপন্থী কবি ও গায়ক বটুকদা (১১ নভেম্বর ১৯১১ - ২৬ অক্টোবর ১৯৭৭)। প্রবাদ-প্রতিম ঋত্বিক ঘটক এর ছবি 'মেঘে ঢাকা তারাʼর তিনিই ছিলেন সংগীত পরিচালক।
কবিরা ছয় ভাই ও ছয় বোন। কবি তৃতীয়। তাঁর অন্য ভাইদের নাম যথাক্রমে জগদিন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথ (সন্ন্যাসগ্রহণের পরে স্বামী বিমলানন্দ), রথীন্দ্রনাথ, রণেন্দ্রনাথ এবং সুধীন্দ্রনাথ। কবির ছয় বোন যথাক্রমে প্রতিভা সিংহ, অণিমা চক্রবর্তী, কণিকা বিশ্বাস, শান্তি রায়, বাসন্তী সিকদার এবং অন্নপূর্ণা রায়।
১৯৩৮ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রিচি রোড নিবাসী বিনয়েন্দ্রপ্রসাদ বাগচীর কন্যা ঊর্মিলা দেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ঊর্মিলা দেবী ১৯৭৩ সালে পরলোক গমন করেন। তাঁদের চার পুত্র-কন্যা যথাক্রমে শান্তনু, সুদেষ্ণা, সিদ্ধার্থ ও সুস্মিতা।
Kishorilal's Mansion at Benaras
বারাণসীতেও কিশোরীলাল একটি প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়ে ছিলেন। যদিও ইন্টারনেটে বেশির ভাগ জায়গাতেই বলছে যে এই বাড়ির গঠনকাল ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৫ এর মধ্যে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে রঘুরাম বা তাঁর ছেলে গোপীকৃষ্ণ-এর মধ্যে কেউ একজন এই অসাধারণ ইন্দো-সারাসেনিক এবং নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের অদ্ভুত মিশ্রণের উদাহরণ এই প্রাসাদটি তৈরি করেন এবং পৈতৃক সূত্রে রাজা কিশোরীলাল এই বাড়িটি পান। এই বাড়ির খিলান, গোল এবং চতুষ্কোণ স্তম্ভ, খড়খড়ি জানলা, ত্রিকোণ পেডিমেন্ট, পুরোনো কাঠের আসবাব আপনাকে এক অদ্ভুত Old-school charm দেবে। এই বাড়ির প্রতিসম নকশা আর দরজা খুললে অবাধ করিডর (বারান্দা) মনে করিয়ে দেয় ঐ সময়ের জনপ্রিয় বাগানবাড়িগুলির কথা। এক সময় এই বাড়িতে এসেছেন অ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গাঁধী প্রমুখ।
![]() |
আজকের ডালমিয়া ভবন (রাজা কিশোরীলালের বারানসীর প্রাসাদ) (from Internet) |
শ্রীরামপুরে আজ গোস্বামীদের বাড়িগুলির অবস্থা বেশ খারাপ, সেই পোড়া কপাল বারাণশীর এই বাড়িটির হয়নি - ১৯৬০ সাল নাগাদ এই বাড়িটি কিনে নেন দেশের অন্যতম শিল্পপতি লক্ষ্মী নিওয়াস ডালমিয়া। তারপর থেকে কামাছাতে কিশোরীলালের বারাণশীর প্রাসাদটিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন ডালমিয়া পরিবার। ডালমিয়া ভবনের পিছনের গেটে এখনো দেখা যায় কিশোরীলালের রাজকীয় সীলমোহর - তাতে কিশোরীলাল গোস্বামীর সংক্ষিপ্ত KLG এবং 'সিদ্ধি সেবিতম ব্রত' লেখা আছে।
![]() |
ডালমিয়া ভবনের গেটে আজ-ও আছে রাজা কিশোরীলালের লোগো (from Internet) |
শেষ কয়েক বছরে এটি ছিল Destination Wedding-এর হটস্পট। এছাড়া রাতে থাকার ব্যবস্থাও ছিল। তবে এখন এটিকে আরো সাজিয়ে, গুছিয়ে ৫-তারা ঐতিহাসিক হোটেল খোলার কথা চলছে। লক্ষ্মী ডালমিয়ার পুত্র কুনাল এই হোটেলের নাম রাখছেন তাঁর মায়ের নামে - সাবো বুটিক হোটেল (https://www.sabo.co.in)।
এই লেখা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু একদিন শ্রীরামপুরে ঘুরতে গিয়ে খেয়াল করলাম এই এক-ই লোগো এখনো আছে শ্রীরামপুরের রাজা কিশোরীলালের বাড়ির গায়ে - অযত্নে, নোংরায় ঢাকা সেই লোগো কাষ্ট আয়রনের তৈরি বলে এখনো টিকে আছে।
![]() |
রাজা কিশোরীলালের লোগো (শ্রীরামপুর) |
তথ্যসূত্রঃ
No comments:
Post a Comment