চুঁচুড়া বা Chinsurah আজকে হুগলী জেলার গঙ্গাতীরবর্তী একটি শহর। কেউ আবার বলেন চুঁচড়ো। এর ঠিক পূর্বে, গঙ্গার উলটো পাড়ে আছে নৈহাটি (উত্তর ২৪ পরগণা)। এখানে ডাচেরা প্রায় ২০০ বছর ধরে ছিল (১৬২৮-১৮২৫)।
ডাচদের সাথে স্থানীয় বাঙ্গালীদের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। স্থানীয় পটুয়াপাড়ার শিল্পীদের নিয়ে ডাচ কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু কাজ করেন - ফলে গড়ে ওঠে 'Dutch Bengal Art'। এই চিত্রকলার ছবিগুলিতে দেখা যায় মূলত ল্যান্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট, এবং ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক দৃশ্য।
উইলিয়াম হজস, হেন্ড্রিক ভ্যান শুইলেনবার্গ, এবং অন্যান্য ডাচ শিল্পীদের কাজের মাধ্যমে এই চিত্রকলার নিদর্শন দেখা যায়। তবে এই আর্ট-এর উদ্ভাবনে শুধু ডাচ নয়, ইংরেজ, ফরাসী এবং ভারতীয় শিল্পীদের অবদানও ছিল। কলকাতায় তখন চলছে ধনী বাঙ্গালীবাবুদের চরম বাবুয়ানা - তারা ইউরোপীয় শিল্পীদের দিয়ে প্রথমে নিজেদের ছবি আঁকানোর পর ইচ্ছে হল দেবদেবীদের ছবি আঁকানোর।
সেই অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় শিল্পীরা এক-একটা তৈলচিত্রের দামও হাঁকাতেন সেই রকম। ১৭৯৮ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা গেজেটে বেরোলো জনৈক শিল্পী মিস্টার মরিস-এর বিজ্ঞাপন - শুধু মুখের ছবি এঁকে দেবেন ১৫ সোনার মুদ্রায়, আর ৮০ স্বর্ণমুদ্রায় এঁকে দেবেন পুরো শরীর। সেই সময় কলকাতার রেট চড়া হলেও অন্য ইউরোপীয় কলোনি, যেমন চন্দননগর বা চুঁচুড়াতে রেট কম পড়ত। চুঁচুড়ার পটুয়াপাড়ার শিল্পীদের সাথে মিশে এই ইউরোপীয় শিল্পীরা আঁকতে শুরু করলেন হিন্দু দেবদেবীদের ছবি, পুরাণের ছবি - সবই যদিও ফরমায়েসি ছবি।
![]() |
ডাচ কলোনি, চিনসুরা - উইলিয়ম হজস |
তেলরঙে আঁকা এই সব ছবিগুলিতে বিষয়বস্তু পৌরাণিক হলেও রঙের ব্যবহার, অ্যানাটমি ইত্যাদিতে ইউরোপীয় পোর্টেট বা ল্যান্ডস্কেপ আর্টের প্রভাব স্পষ্ট। যেমন দুর্গা-গণেশের ছবিতে মা মেরী এবং যিশুর প্রভাব স্পষ্ট।
![]() |
'গণেশ-যিশু' |
আবার অন্য ইউরোপীয় শিল্পীর আঁকা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার ছবিতে আমরা দেখছি যে কালীঘাট বা চুঁচুড়ার পটের কোমলতা নেই, বরং ইউরোপীয় কাঠিন্য, পিছনে পটের চালচিত্রের বদলে পাহাড়, জঙ্গল।
কালীঘাটের পট বা মিনিয়েচারের চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এইসব ছবি অনেক বেশি নাটকীয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, বিষ্ণুর অনন্তশয্যা থেকে শুরু করে কৃষ্ণলীলা বা যশোদা জননী, সবই ঠাঁই পেত এইসব ছবিতে। ফিউশনও এসেছে এসব ছবিতে - যেমন দুর্গার সঙ্গে একই ফ্রেমে কল্কি অবতার।
No comments:
Post a Comment