Pages

Saturday, June 29, 2024

ব্যারাকপুরের গপ্পোঃ বারানশী ঘোষ (Ghose) এবং তাঁর স্নানের ঘাট

দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের আদলে তৈরি ব্যারাকপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল অন্নপূর্ণা মন্দির বা 'শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির এবং দেবোত্তর এস্টেট' - রাণী রাসমণির ছোটমেয়ে এবং মথুরা মোহন বিশ্বাসের দ্বিতীয় স্ত্রী জগদম্বা দেবী ১৮৭৫ সালে এই মন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরের ব্যাপারে বিশদে এখন আর যাচ্ছি না। 

শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির এবং দেবোত্তর এস্টেট

এই অন্নপূর্ণা মন্দিরের কাছাকাছি ৩ টি গঙ্গার ঘাট আছে - অন্নপূর্ণা মন্দিরের ঘাট ছাড়াও শশ্মান ঘাটের একটি ঘাট এবং রাসমণী ঘাট (যেখান থেকে হুগলীর বল্লভপুরের ফেরি ছাড়ে)। এখন অনেকেই অন্নপূর্ণা মন্দিরের ঘাটটিকেই রাসমণী ঘাট বলে থাকেন। আবার ফেরিঘাটটির নামও রাসমনি ফেরি ঘাট। এই ফেরিঘাটের ঠিক পাশের ঘাটটি আসলে স্বর্গত বারানশী ঘোষের স্নানের ঘাট। ১৭৮০ সালে (১১৮৯ বঙ্গাব্দ) এই ঘাটটি প্রথম তৈরি করেন বারানশী ঘোষ (Ghose)। 

এখন প্রশ্ন হল এই বারানশী ঘোষ কে  ছিলেন? ইণ্টারনেট খুঁজে, আর কিছু বই (pdf) ঘেঁটে যেটুকু পেলাম তাই শেয়ার করলাম। 

অন্নপূর্ণা মন্দিরের ঘাট

মনোহর ঘোষ ছিলেন হুগলীর আখনার ঘোষ পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন রাজা টোডরমলের (১৫০০-১৫৮৯) গোমস্তা, পরে হন মুহুরি। এই আখনা সম্ভবত গঙ্গার উল্টো পাড়ের আকনা। গৌড়ের রাজা আদিশূর যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আর পাঁচজন কায়স্থকে বাংলায় নিয়ে আসেন, সেই কায়স্থদের মধ্যে একজন ছিলেন মকরন্দ ঘোষ, তাঁরই উত্তরপুরুষ হলেন এই মনোহর ঘোষ। মোগল-পাঠান যুদ্ধের পরে সুবর্ণরেখা নদীর ধারে কোন এক জায়গায় কয়েকদিন বসবাস করেন। এরপর চলে আসেন আজকের চিৎপুরে। আজকের চিৎপুরে খগেন্দ্র চ্যাটার্জি রোডে বর্তমান আদি চিত্তেশ্বরী দূর্গা মন্দিরটি তাঁর অর্থানুকুল্যে ১৬১০ সালে স্থাপিত হয়। প্রসঙ্গত জব চার্ণক কলকাতায় আসেন আরো ৮০ বছর বাদে, ১৬৯০ সালে। 

সেই সময় চিৎপুর ছিল জঙ্গলাময়, ডাকাতদের আস্তানা। চিতে ডাকাত বা চিত্তেশ্বর রায় (মতান্তরে চিত্রেশ্বর রায়) নিম গাছের কাঠ থেকে এই দারু-দুর্গা মূর্তি তৈরি করে পুজো করতেন। চিতে ডাকাতের সময়কাল ঠিক করে কোথাওই বলা নেই। তবে জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষে বা আকবরের রাজত্বের শুরুর (১৫৬৬-১৬০৫) দিকে চিৎপুরে চিতে ডাকাতের দাপট চলত বলে মনে করা যেতে পারে। দেবী চিত্তেশ্বরী এখানে দশভুজা, সিংহবাহিনী, অসুরদলনী এবং দূর্গারূপী, তবে এখানে চার সন্তান অনুপস্থিত। মায়ের পায়ের কাছে বাঁদিকে একটা ছোট বাঘের মূর্তি - যা আসলে দক্ষিণ রায়ের প্রতীক। এখানে সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো, গায়ের রঙ সাদা। অসুরের গায়ের রঙ সবুজ। বাঘের মূর্তির উপস্থিতি প্রমাণ করে এই অঞ্চল যে সুন্দরবনের অংশ ছিল এবং এখানে বাঘের উপদ্রবও ছিল। তা থেকে বাঁচার জন্যই বাঘের মূর্তিটিকে পুজো করা হত। চিতে ডাকাতের সময় থেকে অমাবস্যায় এই মন্দিরে নিয়ম করে নরবলি হত। এছাড়া ডাকাতি করতে যাওয়ার আগেও নরবলি দিয়ে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যেত। 

কেউ বলেন বাংলার নবাব আলিবর্দী খান বা তাঁর সেনাপতির হাতে চিতে ডাকাত ধরা পড়ে, বিচারে প্রাণদণ্ড হয়। কিন্তু নবাবের রাজত্বকাল ছিল ১৭৪০-১৭৫৬ সাল, কাজেই সময় মিলছে না। বরং তৎকালীন বাংলার নবাবের এক সেনা-কর্মচারী চক্রপাণী চিতে ডাকাতকে ধরে ফাঁসি দেন - এই বক্তব্য অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। 

চিতে ডাকাতের মৃত্যুর পর এই মূর্তি কালের নিয়মে হারিয়ে যায় জঙ্গলে। তবে পরবর্তীকালে এই মন্দিরে বলি ফিরে আসে -  মনে করা হয় যে ১৮৩০-৩৫ সাল অবধি এই মন্দিরে গোপনে নরবলি হয়েছে। ইংরেজ গেজেট বলছে সর্বাধিক নরবলি নাকি এখানেই হয়েছে। 

এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। অনেকে মনে করেন চিতে ডাকাত এই দেবীর প্রতিষ্ঠাতা নন, তার আগে থেকেই দেবীর অস্তিত্ব ছিল। যাই হোক তখন দেবীর নাম কি ছিল কেউই জানে না। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক শিল্প নিদর্শন এই চিত্তেশ্বরী মূর্তি। 

১৫৮৬ সালে নৃসিংহ ব্রহ্মচারী এখানে পঞ্চমুণ্ডীর আসন স্থাপন করে তন্ত্রসাধনা শুরু করেন এবং এই সময়ে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবী চিত্তেশ্বরীর পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। নৃসিংহ ব্রহ্মচারী দেবীর বক্ষস্থলে আট চরণে লেখা দুটো শ্লোক দেখতে পান।  তিনি ওই মন্ত্রেই দেবীর পুজো শুরু করেন। তারপর থেকে ওই গুপ্তমন্ত্রেই দেবীর পুজো হয়। 

সেই সময় মুর্শিদাবাদের কুলাই গ্রামের জমিদার হলেন মনোহর ঘোষ। কালক্রমে কাশীপুরের নিকটস্থ এই চিতপুরের জঙ্গলও তাঁর জমিদারির মধ্যে পড়েছিল। তিনি চিতপুরে এসে জঙ্গল সরিয়ে জনবসতি বসাতে চেয়েছিলেন। তখন স্থানীয়রা এসে তাঁকে দেবীর মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানালে তিনি ৩৬ বিঘা জমি দেবীর উদ্দেশ্যে দান করেন - চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দিরও তৈরি হল ১৬১০ সালে। এবং এই মন্দির নির্মানের সময় জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার সময় খুঁজে পাওয়া যায় এক অদ্ভুত দর্শন শিবলিঙ্গকে৷ যেটা দেখতে অনেকটা পদ্মকোরকের মতন। এই শিবলিঙ্গে গৌরিপট্ট অনুপস্থিত। মনোহর ঘোষ মায়ের মূর্তির সাথে সেই শিবলিঙ্গকেও প্রতিষ্ঠা করেন৷ এখনো মায়ের গর্ভগৃহের পাশের ঘরেই সেই শিবলিঙ্গ পূজিত হয়ে আসছে। 

কালীক্ষেত্র কলকাতার দুই প্রান্তে দুই মা - উত্তরে গঙ্গার ধারে চিতপুরের মা চিত্তেশ্বরী আর দক্ষিণে আদিগঙ্গার ধারে কালীঘাটের মা কালী। কালীঘাট আসলে একটি সতীপীঠ এবং ৫১ শক্তিপীঠের একটি - এখানে সতীর দক্ষীণানী বা ডান পায়ের আঙ্গুল পড়েছিল। কাজেই কালীঘাটের ইতিহাস সেই পৌরাণিক যুগ থেকেই ছিল। তবে আজকের কালীঘাটের মন্দিরের যেরূপ দেখছি আমরা সেই মন্দির তৈরি শুরু করেছিলেন কালীভক্ত সন্তোষ রায় চৌধুরী ১৭৯৮ সাল নাগাদ। ১৮০৯ সালে কালীঘাটের এই মন্দির নির্মাণ শেষ হয় বরিশার সাবর্ণ জমিদারদের আর্থিক আনুকূল্যে। সেই ৫০০ বছর আগেও চিতপুর থেকে কালীঘাট অবধি একটি রাস্তা ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, যাকে ব্রিটিশরা তীর্থযাত্রীদের পথ (Pilgrim's path) বলত, পরে তারই নাম হয় চিতপুর রোড (Chitpur Road) - এখন তার নাম রবীন্দ্র সরণী। এই রাস্তাটিই সম্ভবত কলকাতার সবথেকে পুরোনো রাস্তা। সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় হালিশহর থেকে বড়িশা পর্যন্ত একটি রাস্তা বানিয়েছিলেন। সেই রাস্তার কিছু অংশ ছিল এই চিৎপুর রোড। প্রসঙ্গত লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় থেকে এই পরিবার সাবর্ণগোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবার নামে পরিচিতি পায়। 

পরবর্তীকালে ইংরেজরা চিত্তেশ্বরী মন্দিরের কিছু জমি অধিগ্রহণ করেই স্থাপন করে আজকের কাশীপুর গান এণ্ড শেল ফ্যাক্টরি। ১৮০২ সালের ১৮ মার্চ থেকে এই কারখানার কাজ শুরু হয়, তখন নাম ছিল Gun Carriage Agency। স্বাধীনতার পর মার্চ ১৮ তারিখটিকে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি দিবস হিসেবে পালিত হয়। 

মন্দিরের গায়ে একটা বোর্ডে লেখা আছে - "৩৮৮ বৎসর পূব্বে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ অগ্রদ্বীপের ও ঘোষপাড়ার বাসুদেব ঘোষের বংশধর বর্দ্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানায় কুলাই গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ ও তাহার পত্নী সেওড়াফুলী রাজার কন্যা উভয়ে ইং ১৫৮৬ সালে এই চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির স্থাপন করিয়া কিছু ভূসম্পত্তিসহ তদীয় সেবাইত মহন্ত নৃসিংহ ব্রহ্মচারীকে দান করেন।" 

নৃসিংহ ব্রহ্মচারী ছিলেন অবিবাহিত। তাঁর তিরোধানের পর তার শিষ্যরাই পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন। এইভাবে চলতে চলতে তাঁর এক শিষ্য শ্যামসুন্দর বিবাহ করেন। তাঁর দুটি কন্যার মধ্যে ছোট কন্যা ক্ষেত্রমণির বিবাহ হয় হালিশহরের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের এক বংশধরের সাথে। তার বড়কন্যার বিবাহ হয়নি। তারপর থেকে হালিশহরের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারেরর সদস্যরাই বংশ পরম্পরায় এই মন্দিরের পুজোর দায়িত্বভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। এখন মন্দিরের সবকিছুর দায়িত্বে আছেন কাশীশ্বর রায় চৌধুরী - শ্যামসুন্দরবাবুর ছোট কন্যার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অষ্টম বংশধর। 

এরপর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে বিখ্যাত "ব্ল্যাক জমিদার" গোবিন্দরাম মিত্র (Gobindram Mitter) (১৬?? - ১৭৬৬) নতুন ভাবে মন্দির নির্মান করে দিয়েছিলেন। এই গোবিন্দরামও ছিলেন আদতে চানকের বাসিন্দা, ১৬৮৬-৮৭ সাল নাগাদ গোবিন্দপুরে চলে আসেন (এখন যেখানে ফোর্ট উইলিয়ম‌), পরে কুমোরটুলিতে থাকতেন। তাঁর পিতার নাম রত্নেশ্বর, পিতামহ হংসেশ্বর। 

১৭১৭ সালে মোঘল বাদশা ফারুখশিয়ারের ফরমান পেল ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি - পুরো বাংলাদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার কোম্পানি পেলই সেইসাথে পেল হুগলী নদীর উভয় তীরে প্রায় ১০মাইল অবধি ৩৮টি গ্রাম কিনে নেওয়ার অধিকার। এই অধিকার বলে কোম্পানি হয়ে গেলো সম্পূর্ণ ২৪ পরগণার জমিদার। তবে এই জমিদারি কোম্পানির হাতে থাকলেও তাকে সাহায্য করার জন্য ডেপুটি জমিদার পদও তৈরি হল। এই ডেপুটি পদে কিন্তু লোক নেওয়া হল নেটিভ বা দেশি কাউকে। এদেরকেই সাহেবরা বলতেন ব্ল্যাক জমিদার। ১৭২০ সালে প্রথম ব্ল্যাক জমিদার হিসাবে নিযুক্ত হলেন গোবিন্দরাম মিত্র। কুমোরটুলির মিত্র পরিবারের আদি পুরুষ। ৩০ টাকা মাসমাইনে (পরে বেড়ে ৫০টাকা) হলেও বিভিন্ন ভাবে গোবিন্দরাম নানা উপায়ে অনেক টাকা করেছিলেন। স্বনামে বেনামে ব্যবসা করে, ভালো বাজারগুলো ইজারা নিয়ে, শস্তায় নিজের আশ্রিতদের মধ্যে জমিবিলি করিয়ে দিয়ে, আদায়ী খাজনার টাকা গড়বড় করে তিনি একেবারে শূন্য থেকে রাতারাতি বড়লোক হয়ে পড়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার পতন হলে নবাবের কোষাগার থেকেও মোটা টাকা সরিয়েছিলেন গোবিন্দরাম। 

কলকাতায় ঘোড়ায় টানা জুড়িগাড়ির প্রথম বাঙ্গালী মালিক ছিলেন গোবিন্দরাম মিত্র। সেকালের এক তরজায় কলকাতার আট বাবুর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কুমারটুলির গোবিন্দরাম মিত্র সম্বন্ধে বলা হয়েছে,"কালো দেশের কালো মানুষ কালো জমিদার/ গোবিন্দরাম মিত্রি আনেন জুড়িগাড়ির বাহার।" কলকাতার বাবুয়ানির জনক হিসেবেও গোবিন্দরামকে মান্যতা দেওয়া যায় - তিনি প্রচুর জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা-পার্বণ করতেন। তাঁর সময়ে দুর্গা প্রতিমাকে স্বর্ণ ও রৌপ্য পাতে মোড়া হত। তাঁর দুর্গার বৈশিষ্ট্য ছিল রামচন্দ্রের উপস্থিতি। এর পাশাপাশি দেবীর ভোগের জন্য তিরিশ থেকে পঞ্চাশ মন চাল ব্যবহার করা হত ও এক হাজার ব্রাহ্মণদের ভোজন করানো হত ও নানাবিধ উপহার দেওয়া হত।  

Gentoo Pagoda and House - Thomas Daniel's Painting (1787)

১৭২৫ সালে (মতান্তরে ১৭৩০-৩২ সালের মধ্যে) কুমোরটুলীতে একটি নবরত্ন মন্দির স্থাপন করেন - ব্ল্যাক জমিদারের বানানো এই মন্দিরটি 'ব্ল্যাক প্যাগোডা' নামে পরিচিত ছিল। মূল দেবতা ছিলেন মহাদেব। সেই সময়ে এর চূড়ার উচ্চতা ছিল ১৬৫ ফুট। ১৭৩৭ সালের ভূমিকম্প এবং ঝড়ে এই চূড়াটি ভেঙ্গে পড়ে। কেউ এই মন্দিরটিকে বলেছেন ‘মিত্রের প্যাগোডা’, ১৮৩০ সালে Charles D’Oyly-এর আঁকা ছবিতে এর নাম হিন্দু মঠ (Hindu Mut in the Chitpore Bazar), কেউ বা বলেছেন জেণ্টু প্যাগোডা। ১৮১৩ এবং ১৮৪০ সালে এই মন্দিরটি প্রায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু কোনভাবে আজও টিকে আছে - গায়ে পড়েছে সংস্কারের রং। বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের কাছে এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। (গুগল ম্যাপে লোকেশনঃ J927+28)। বলে রাখা ভালো সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরটিও এই মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠিত, তবে গোবিন্দরামের অনেক পরে এই মন্দিরের আজকের রূপ নির্মিত হয়। 

১৭৫২ সালে গোবিন্দরামের উর্ধস্তন কর্তা হয়ে আসেন জন জেফানিয়া হলওয়েল (John Zephaniah Holwell) - উনি শুরুতেই বুঝতে পারেন গোবিন্দরামের উপরি আয়ের ব্যাপারটা। কিন্তু গোবিন্দরামের বিরুদ্ধে কাউন্সিলে অভিযোগ করেও বিশেষকিছু লাভ হয়নি। টাকা খাইয়ে, নরম- গরমে গোবিন্দরাম এই বিপদ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে আসেন। শহরের নিরাপত্তার জন্য প্রথম পুলিশি ব্যবস্থা, কলকাতা পুরসভা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যতম ভূমিকা ছিল। তবে ১৭৫৬ সালেই গোবিন্দরামকে অবসর দেওয়া হয়। তারপরেও ব্যবসা বাণিজ্য করে পয়সা উপার্জন করে গেছেন গোবিন্দরাম। 

কুমারটুলির নামের পিছনেও নাকি আছেন গোবিন্দরাম মিত্র। তাঁর আস্তাবলে অনেকগুলি ঘোড়া ছিল, এবং তাদের দেখার জন্য বেশ কিছু সহিসও নিযুক্ত ছিল। এরা এই অঞ্চলেই থাকতে শুরু করে এবং জায়গার নাম কুমারটুলি হয়। কারণ এই 'কুমার'-এর অর্থ ঘোড়ার সহিস (সূত্রঃ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ ও নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ)। 

কেউ কেউ বলেন কুমারটুলি নয়, কথাটা কুমোরটুলি। ১৭৮১ সালে গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়মের কাজ শুরু হওয়ার আগে এখানকার বাসিন্দাদের সুতানটি অঞ্চলে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। গোবিন্দপুরের ধনীরা চলে আসেন পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। ১৭৫৭ সালের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে আদেশ দেওয়া হয় একই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা থাকবেন একটি নির্দিষ্ট স্থানে। সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে কলুটোলা, আহিরীটোলা, সুরিপাড়া (সুরা বিক্রেতাদের জন্য), ছুতোরপাড়া এবং অবশ্যই কুমোরটুলি। এই কুমোরটুলিতে তখন, প্রায় ৩০০ বছর আগে কলকাতার আদি কুম্ভকাররা বাস করতেন এবং মূলত তৈরি করতেন মাটির বাসনপত্র। এদের আদি নিবাস ছিল হুগলির সপ্তগ্রামে। সরস্বতী নদী মজতে শুরু করলে তারা এসে ওঠে আজকের কুমোরটুলিতে। রাজা নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় শুরু করেন দুর্গাপুজো, সময়টা ১৭৫৭ - নদিয়া, কৃষ্ণনগর থেকে আসতে শুরু করেন মৃৎশিল্পীরা। শুরু হয় ঠাকুর প্রতিমার বানানোর কাজ, যা আজ কুমোরটুলিকে বিশ্বখ্যাতি দিয়েছে। একসময় এখানে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মৃৎশিল্পী ছিলেন এবং ছিল প্রায় ৫৫০ দোকান কাম ওয়ার্কশপ। বিভিন্ন কারণে এই শিল্পে এসেছে ভাটা - তাও প্রায় ১০০টির কাছাকাছি স্টুডিও এখনো চলছে।  

কুমোরটুলি নিয়ে এত কথা হলই যখন বনমালী সরকারের কথা বলেই যাই। প্রবাদ ছিল, ' ‘গোবিন্দরামের ছড়ি/ বনমালী সরকারের বাড়ি/... ' গোবিন্দরামের প্রবল দাপটের কথা তো আগেই বলেছি। বনমালী সরকার পাটনার প্রথম দেওয়ান ছিলেন এবং পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর 'ডেপুটি ট্রেডার' পদে আসীন হন। ১৭৪০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে কলকাতার কুমোরটুলি এলাকায় তিনি একটি বিশাল বাসগৃহ তৈরি করেন। আজ সেই বাড়িটি নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেলেও তাঁর নামাঙ্কিত 'বনমালী সরকার স্ট্রিট' এখনো আছে। ২/৫ নং বনমালী সরকার স্ট্রীটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাণেশ্বর শিবের বৃহদাকার আটচালা মন্দিরটি আজও টিকে রয়েছে। স্থাপত্য বিচারে মন্দিরটির যত না গুরুত্ব, এটির প্রবেশপথের দেওয়ালে নিবদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি ও সামাজিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে উৎকীর্ণ সাবেকি ‘টেরাকোটা’ ভাস্কর্যফলকগুলি আজও প্রথাগত মন্দিরসজ্জার ধারা বহন করে চলেছে। 

১৭৬৬-তে প্রবীণ বয়সেই গোবিন্দরামের মৃত্যু হয়। মৃত্যর আগে নন্দবাগানে একটি প্রসাদোপম বাড়ি বানান, সেখানে উঁমিচাঁদেরও একটি বাড়ি ছিল। ফলে দুই বাগানবাড়ি মিলে এলাকার নাম হয় জোড়াবাগান। গোবিন্দরামের এক ছেলে ছিল - রঘুনাথ মিত্র (Rughoonauth Mitter) (১৭৪১-১৭৭৫)। পূর্বপুরুষের জমানো সম্পত্তি তিনি পুজো আর্চা, বিলাস ব্যসনে এবং দানধ্যানে ভালোই খরচ করেন। অনেকে মনে করেন বাগবাজার ঘাটের প্রথম নির্মাণ রঘুনাথ মিত্রই করেন। রঘুনাথের পাঁচ পুত্র - রাধাচরণ  (Radhachurn) - মূলত চিতপুরে থাকতেন, কৃষ্ণচরণ (Crishnachurun) - থাকতেন নন্দনবাগানে, গোলোকমোহন (Golokemohun) - অপুত্রক, রসময় (Rusomoy) - অপুত্রক এবং রাজেন্দ্র নারায়ণ (Rajendernarain)। রঘুনাথের পঞ্চম পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ (বা আনন্দময়) ছিলেন রাজশাহীর দেওয়ান এবং বেনারসে থাকতেন। এই সময়ে মিত্রি পরিবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় - কুমোরটুলির মিত্রি এবং বেনারসের মিত্রি বংশ। রাধাচরণের পুত্র অভয়চরণ মিত্র কুলগুরুকে এক লক্ষ টাকা দান করে আদর্শ শিষ্য হিসাবে কলকাতায় খ্যাত হন। কৃষ্ণচরণের পৌত্র কাশীশ্বর ছিলেন হুগলীর প্রধান সদর আমীন এবং রাজা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ও গোঁড়া ব্রাহ্ম। 
 
ফিরে আসি চিত্তেশ্বরী মন্দিরে, আজকের আদি চিত্তেশ্বরী বা জয়চণ্ডী চিত্তেশ্বরী মন্দিরটির রূপদান করেছিলেন কাশীপুর নিবাসী কালীকৃষ্ণ রায়বাহাদুরের ভগিনী শ্রীমতী সূর্যরানী দাসী। 

চিত্তেশ্বরী মন্দিরের সাথে যোগ আছে কালীসাধক রামপ্রসাদেরও। তখন রামপ্রসাদ সেন কাজ করতেন দর্জিপাড়ায় দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায়। মাসে একদিন করে হালিশহর ফিরতেন নদীপথে নৌকা করে, গাইতে গাইতে আসতেন একের পর এক স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত। উদাত্ত গলার সেই গান শুনতে পেতেন গঙ্গাতীরের লোকজন। রামপ্রসাদের গানের রেশ পৌঁছত চিত্তেশ্বরীর মন্দিরেও। কিন্তু দেবী ঠিকমতো শুনতে পেতেন না সেই গান। সরাসরি রামপ্রসাদকেই চিত্তেশ্বরী বলেন, ‘‘কী গান করিস! ভালমতো শুনতেই পাই না!’’ রামপ্রসাদ দমবেন কেন? তিনি দেবীকে পাল্টা বলেন, ‘‘অতই যদি গান শোনার সাধ, তা হলে গঙ্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়া!’’ দেবী আর কথা বাড়াননি। গঙ্গার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ান। তার পর থেকেই চিত্তেশ্বরীর মুখ গঙ্গার দিকে খানিক বাঁকানো।

গোবিন্দরাম মিত্র নিয়ে এত কথা বলার একটাই কারণ, তিনিও ছিলেন এই বারাকপুর/চানকের বাসিন্দা। 

ফিরে আসি মনোহর ঘোষের কথায়। পরবর্তীকালে মনোহর ঘোষ চিৎপুর ছেড়ে 'চন্নরপুকুর' (চানকের চন্দনপুকুর) এসে বসবাস শুরু করেন। মৃত্যু (১৬৩৭ সাল) অবধি মনোহর ঘোষ মূলত এখানেই থাকতেন। মনোহর ঘোষের পুত্র (বা ভাতুষ্পুত্র) ছিলেন রাধাকান্ত ঘোষ। রাধাকান্তের পুত্র ছিলেন বারাণশী ঘোষ, যিনি পরে ২৪ পরগণার কালেক্টর গ্ল্যাডুউইন সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। প্রথম জীবনে বারাণশী ঘোষ চন্দনপুকুরে থাকতেন এবং ১৭৮০ সালে তালপুকুর সংলগ্ন গঙ্গায় একটি ঘাট বানিয়ে দেন। এই ঘাটের চাঁদনির গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে সে'সব লেখা আছে। ১৯০৯ সালে এই ঘাটটিকে মেরামত করে দেন তালপুকুর নিবাসী শ্রীকৃষ্ণনাথ মুখোপাধ্যায়। 

বারাণশী ঘোষের স্নানের ঘাট - এর ডানদিকে শশ্মান এবং বাঁদিকে ফেরীঘাট


ঘাটের চূঁড়া - ১ 

নদীর দিক থেকে বারাণশী ঘোষের স্নানের ঘাট

ঘাটের চূঁড়া - ২ (নদীর দিক থেকে) 

হুগলী নদীর দৃশ্য

ঘাটের কাহিনী ১ 


ঘাটের কাহিনী - ২

জোড়াসাঁকোর শান্তিরাম সিংহের মেয়ের সাথে বারাণসী ঘোষের বিবাহ হয়। বিয়ের পর জোড়াসাঁকোয় তিনি এক প্রকাণ্ড বাড়ি তৈরি করে সেখানেই থাকতেন। সেই সুবাদে ঐ রাস্তার নাম হয়ে যায় বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট। আজও সেই রাস্তা এই নামেই আছে। 

হুগলীর জনাইএর কাছে বাকশার বাসিন্দা শান্তিরাম সিংহ ছিলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালেকটর মি: মিডলটন এবং স্যার টমাস রমবোল্ড সাহেবের দেওয়ান - মূলত পাটনা এবং মুর্শিদাবাদ জেলার কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। শান্তিরামের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সম্পত্তি ছিল দুই নাবালক পুত্র - প্রাণকৃষ্ণ এবং জয়কৃষ্ণ-এর নামে। এই উইলের দায়িত্ব ছিল তিনজনের হাতে - দর্জিপাড়ার নীলমণি মিত্র, শান্তিরামের নিজের জামাই বারাণসী ঘোষ এবং শান্তিরামের শালা, সরশুনার সীতারাম ঘোষ। কিন্তু ঝামেলা বাঁধল প্রাণকৃষ্ণ এবং জয়কৃষ্ণ বড় হলে, নীলমণি মিত্র এবং বারাণসী ঘোষ এই বিপুল সম্পত্তি ছেড়ে দিতে রাজি হলেন না। তখন সদ্য-যুবা এই দুই ভাইএর পাশে দাঁড়ালেন মামা সীতারাম ঘোষ। মামলা-শেষে প্রাণকৃষ্ণ এবং জয়কৃষ্ণ পেলেন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। এর পর প্রাণকৃষ্ণ সীতারাম-পুত্র অভয়চরণ ঘোষকে জোড়াসাঁকোতে নিয়ে আসেন। অভয় চরণ জোড়াসাঁকোতে ২৭ বারাণশী ঘোষ স্ট্রীটে একটি বাড়ি বানান। এই বাড়ির সামনে অভয় চরণের কনিষ্ঠ পুত্র হরচন্দ্র ঘোষের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়। ডেভিড হেয়ার এবং ডিরোজিও-এর ছাত্র হরচন্দ্র ঘোষ (১৮০৮-১৮৬৮) প্রথমে ছিলেন মুন্সিফ, পরে কলকাতার জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট হন। তার পরে পদোন্নতি হয়ে Small Causes Court এ জজসাহেব ছিলেন আমৃত্যু। 

হুতোম পেঁচার নকশার লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ এই বংশেই জন্মেছিলেন। শান্তিরামের কনিষ্ঠ পুত্র জয়কৃষ্ণ, তাঁর পুত্র নন্দলাল, এবং নন্দলালের পুত্র হলেন এই কালীপ্রসন্ন। কালীপ্রসন্ন মহাভারতের বঙ্গানুবাদও করেছিলেন। কালীপ্রসন্নের সাথে হরচন্দ্র ঘোষের ভাল সম্পর্ক ছিল। 


তথ্যসূত্রঃ
বারাকপুরের সেকাল একাল - কানাই পদ রায়
https://puronokolkata.com/2019/08/06/navaratna-temple-of-gobindram-mitter/
https://www.facebook.com/groups/166757780691118/user/100010158634716/
https://calcuttaandkolkata.weebly.com/gobindaram-mitras-pagoda.html
https://www.ebanglalibrary.com/lessons/কুমারটুলির-গোবিন্দরাম-মি/
https://pagefournews.com/the-creator-of-the-name-kumartuli-is-govindram-mitra/
https://www.jiyobangla.com/bn/news/gobindaram-mitra-the-first-babu-of-calcutta
https://en.wikipedia.org/wiki/Chitpur
https://historicalleftovers.wordpress.com/2020/07/27/কলকাতার-ব্ল্যাক-প্যাগোডা/
https://www.tripoto.com/kolkata/trips/kumartuli-a-walk-through-a-cultural-precincts-of-kolkata-5847fd4090014
https://bn.wikipedia.org/wiki/কুমারটুলি
https://www.prohor.in/a-write-up-about-history-of-kumartuli
https://www.telegraphindia.com/west-bengal/heritage-label-only-for-arched-gate/cid/1493017
এবং অন্যান্য

No comments: