ডোকরা হল ভারতবর্ষের অন্যতম পুরোনো আদিবাসী শিল্পকলা যার ইতিহাস প্রায় ৪৫০০ বছরের। মনে করা হয় ‘হারানো মোম ঢালাই’ পদ্ধতির (Lost or vanishing wax casting method) এই শিল্পকর্মের বিকাশ ভারতে প্রথম ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের বস্তার অঞ্চলে ডোকরা-ডামার উপজাতি মানুষদের হাতে। তাঁদের নামেই এই শিল্পের নাম 'ডোকরা'। কথিত আছে প্রায় ৩০০০ বছর আগে বস্তারের রাজা তাঁর রাণীর জন্য ডোকরার গয়না তৈরি করিয়েছিলেন। তবে সিন্ধু সভ্যতার শহর মহেঞ্জদোড়োতে প্রাপ্ত "ড্যান্সিং গার্ল" বা "নৃত্যরত নারী মূর্তি" হল ডোকরা শিল্পের এক প্রাচীন নিদর্শন। কাজেই এই শিল্পের মূলধারা কোথায় সে বিষয়ে যথেষ্ট তর্কবিতর্ক আছে।
পরবর্তীকালে এই ঋতুকেন্দ্রিক যাযাবর জাতির ডোকরা শিল্পীরা ঝাড়খন্ড-বিহার পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় ছড়িয়ে পড়েন। মোটামুটি ভাবে ১৫০-২০০ বছর আগে ডোকরা শিল্পীরা বাংলায় এসে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুরে স্থায়ী বসতি শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিকনা, খাতডার লক্ষীসাগর, লাদনা, ছাতনা, শববেড়িয়া, বর্ধমান-গুসকরার আউশগ্রামের দ্বারিয়াপুর/দরিয়াপুর ও পুরুলিয়ার নাডিহায় ডোকরা শিল্পের প্রধান কেন্দ্র গুলি অবস্থিত। এর মধ্যে বাঁকুড়ার বিকনা ও বর্ধমানের দরিয়াপুর - এই দুই জায়গার ডোকরা শিল্পের খ্যাতি জগৎজোড়া। মজার ব্যাপার এই শিল্পের উৎকর্ষতা বাড়াতে দরিয়াপুর আর বিকানা - এই দুই গ্রামের মধ্যে বিবাহ রীতি চালু আছে, যার মাধ্যমে শিল্পের আদান-প্রদান হয়। দুই গ্রামেরই ডোকরা শিল্পীদের পদবি কর্মকার।
ডোকরা শিল্প পদ্ধতি একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ সূক্ষ্ম শিল্প কর্ম। প্রথমে শিল্পীরা পুকুর থেকে লাল বা সাদা মাটি সংগ্রহ করেন এবং ধানের তুষ ও পরিমান মতো বালি মিশিয়ে মাটির মণ্ড তৈরি করেন; এর পর মাটি দিয়ে হাতে করে একটি অবয়ব তৈরি করে। অবয়বটির উপর মোম, তেল এর প্রলেপ দেওয়া হয় । শেষে নরম মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এর পর এটিকে পোড়ানো হয়। ফলে মোম গলে একটি ছিদ্র দিয়ে বাইড়ে বেরিয়ে আসে ।এর পর ওই ছিদ্র দিয়ে গলানো পিতল ঢালা হয় এবং শক্ত হলে মূর্তিটি সংগ্রহ করা হয়। মূর্তিটিকে এর পর শিরিষ কাগজ দ্বারা ঘষে উজ্জ্বল করা হয়। ডোকরা শিল্পের কোনো ছাঁচ হয় না। কাজে একই রকম হলেও দুটি কাজের মধ্যে কিছু তফাৎ থেকেই যায়। আর সকল কারুকার্য নিপুণ হাতে তৈরী। এই শিল্পে মহিলাদের সাহায্য অপরিহার্য - পুরুষ শিল্পীরা নকশা তৈরি করার পর মেটাল কাস্টিং পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে মহিলারাই প্রধান ভূমিকা নেন।
১৯৮৮ সালে বিকনা গ্রামের যুদ্ধ কর্মকার (মৃত্যু ২০১৫) চাঁদ সদাগর-এর কাহিনীর আঁকা ডোকরার ‘মনসা ঘট’ তৈরি করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর হাতের কাজেই ডোকরার পরিচিতি অন্যমাত্র পায়, বাড়ে ডোকরার চাহিদা। আশির দশকে ১২টি ডোকরা শিল্পীর পরিবার বিকনায় এসে কলোনি বানিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। যুদ্ধবাবুই এই কলোনির নাম রেখে ছিলেন ‘শিল্প ডাঙা’, যা লোকমুখে পরিচিত ছিল ডোকরা গ্রাম নামে। এখন 'শিল্প ডাঙা'য় পরিবার বেড়ে ৫৫। ঘরে ঘরে সকাল-সন্ধ্যা ডোকরার কাজ চলে। পোড়ামাটির ঘোড়া যদি বাঁকুড়ার গর্ব হয়, তবে ডোকরা শিল্প বাঁকুড়ার অহঙ্কার। তবে '৯০এর দশকে বেশ লোকসানের মুখে পড়েছিল ডোকরা শিল্প। তখনও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন 'ডোকরার যাদুকর' যুদ্ধ কর্মকার।
দরিয়াপুরের স্বীকৃতি আসে আরো আগে। গ্রামের শম্ভু কর্মকার ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। এর ২০ বছর পরে ১৯৮৬ সালে হারাধন কর্মকার, ১৯৮৮ সালে মটর কর্মকার ও বৈকুণ্ঠ কর্মকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১২ সালে রামু কর্মকারও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। এক সময়ে মাত্র ২৫টি পরিবার ছিল এখানে, এখন প্রায় ৪০টি পরিবার এই ডোকরা শিল্পের সাথে যুক্ত। ১৯৯০এর সময়ে ডোকরা শিল্পে চরম মন্দা আসে - অনেক শিল্পীই এই কাজ ছেড়ে রিকশা চালানো, দিনমজুরি শুরু করেন। তারপর আস্তে আস্তে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
এক সময় লক্ষ্মীর ভাঁড়, হাতি, ঘোড়া, চাল মাপার কুনকে, দেবদেবীর মূর্তি (গণেশ, লক্ষ্মী, নারায়ণ) তৈরির মধ্যেই ডোকরা শিল্প সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে ডোকরা শিল্পে নির্মিত শিল্পসামগ্রী বেশ বৈচিত্র্যময়। রামুবাবুর ছেলে শুভ কর্মকার ২০১৪ সালে দরিয়াপুর ছেড়ে কলকাতার মিলন মেলা প্রাঙ্গণে ‘ডোকরা শিল্প’ নিয়ে পা রাখেন। তারপর থেকেই দরিয়াপুরের শিল্পীরা ছক ভেঙেছেন। বাজারের চাহিদামত তাঁদের ভাঁড়ারে অনেক নতুন জিনিস সংযোজিত হয়েছে, যা আকৃষ্ট করছে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের। যেমন জামাকাপড় টাঙানোর হ্যাঙার , ক্লিপ, বোতাম, কানের দুল, বালা, চাবির রিং, ডোকরার গ্রিল, দরজার কড়া, সাবান কেস, আদিবাসী মূর্তি, গয়নার বাক্স, ফল রাখার ঝুড়ি, অ্যাসট্রে, পেপারওয়েট ইত্যাদি দেদার বিক্রি হচ্ছে। উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুম থেকে এখন ডোকরা ঢুকে পড়েছে মধ্যবিত্তের নিত্যপ্রয়োজনে। ২০২৩ সালের বরাহনগরের রামকৃষ্ণপুরম অ্যাপার্টমেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ‘প্রাচীনা’ থিমের দূর্গাপুজোর মূল ভাবনার মাধ্যম ছিল ডোকরা শিল্প।
তৈরি হয়েছে ‘দরিয়াপুর ডোকরা আর্টিজানস কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি লিমিটেড’। এখানে সারা বছর-ই লোকের ভিড় লেগে থাকে। বাইরে থেকে বিদেশীরাও আসেন - কিনতে এবং কিভাবে কাজ হচ্ছে দেখতে। কেউ কেউ আসেন কাজ শিখতেও। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ডোকরা শিল্পীরা যাচ্ছেন গোয়া কার্নিভালে, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও। রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর, ‘খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ’ যৌথ ভাবে দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে - শিল্পীদের শেখান হচ্ছে স্পোকেন ইংলিশ, বোঝানো হচ্ছে অচেনা-বাজার ধরতে গেলে শিল্পকর্মের পরিসরটা কী ভাবে বাড়াতে হয়। দরিয়াপুরে প্রতি বছর রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প, বস্ত্র দফতর এবং ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে ডোকরা মেলার আয়োজন হয়। শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ছাড়াও এখানে থাকে বাউল গান, রায়বেঁশে, ঝুমুর-ছৌ নাচের আয়োজন। মেলায় বিক্রি হোক বা না হোক, ভাল অঙ্কের টাকার বরাত পান শিল্পীরা।
এসব সত্ত্বেও ডোকরা শিল্পীরা সেই অর্থে সেই রকম টাকার মুখ দেখতে পান না। কোভিড অতিমারির সময় আবার ধাক্কা খায় ডোকরা শিল্প। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এই শিল্প। বর্ধিত দ্রব্যমূল্য, পেতলের জোগানের স্বল্পতা, আধুনিক ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদার ক্রমপরিবর্তন প্রভৃতি সমস্যা ও চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়েই বিকনা এবং দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পীরা এগিয়ে চলেছেন।
No comments:
Post a Comment