ব্যারাকপুরের সরকারি হাসপাতালটির নাম ডঃ বি.এন. বসু মহকুমা হাসপাতাল (Dr. B.N. Bose Sub-Divisional Hospital)। অনেকেই একে বীরেন বোস হাসপাতাল বলে ভুল করেন। কিন্তু কে ছিলেন এই ডাঃ বি.এন.বসু?
B.N.Bose এর পুরো নাম ভোলানাথ বসু। ১৮২৪ সালে (মতান্তরে ১৮২৫ সালে) ভোলানাথ বসু চানক মৌজার তালপুকুর গ্রামে জন্মেছিলেন। এই চাণক-ই পরবর্তী সময়ে ব্যারাকপুর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তাঁর বাবার নাম ছিল রামজয় বসু। তাঁদের বাগানবাড়ির বিস্তীর্ণ জমি ৫০ বছর আগেও বোসবাগান নামে পরিচিত ছিল। পরে কৃষ্ণনাথ মুখোপাধ্যায় তা কিনে নিয়েছিলেন। এই জমিতেই আজ জিমন্যাশিয়ামের বিশাল মাঠ।
প্রথমে তিনি গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা করলেও পরে তিনি লর্ড অকল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠিত ব্যারাকপুর বিদ্যালয়ে (আজকের ব্যারাকপুর গর্ভমেণ্ট স্কুল) ভর্তি হয়েছিলেন। লর্ড অকল্যাণ্ড এবং তাঁর বোন এমিলি ইডেন মূলত চারপাশের লোকালয়ের বাঙ্গালী ছেলেদের জন্যই এই স্কুলটি স্থাপন করেন। তারা মাঝে মাঝে সেই বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতেন এবং পড়াশুনার ব্যাপারে ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন। ১৮৪০ সালে লর্ড অকল্যাণ্ডই ভোলানাথকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভোলানাথ বসুর জন্য মাসিক দশ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হওয়ার দশ বছর পরে, ১৮৪৫ খ্রীস্টাব্দে, ঐ কলেজের চারজন ছাত্র প্রথমবারের জন্য ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন৷ সেই চারজন ছাত্র ছিলেন - ‘ভোলানাথ বসু’, ‘দ্বারকানাথ বসু’, ‘গোপালচন্দ্র শীল’ (Gopal Chunder Seal) ও ‘সূর্যকুমার চক্রবর্তী’ (Soorjocoomar Goodeve Chuckerbutty, wiki)। সেই চারজন তরুণ বাঙালীর ইংল্যাণ্ডে ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার পিছনে একটু ইতিহাস রয়েছে।
মিশর থেকে এম. ক্লট বে (M. Klot Bey), ডাক্তারি পড়বার জন্য কয়েকজন মিশরীয় ছাত্রকে নিয়ে প্যারিসে গিয়েছিলেন। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ Dr. Mountford Joseph Bramley (more about Dr. Bramley) সেই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে, মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন প্রতিভাদীপ্ত ছাত্রকে ইংল্যাণ্ডে পাঠানোর জন্য মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু 1837 সালে Bramley সাহেবের আকস্মিক মৃত্যু হওয়ায় মেডিক্যাল কলেজের প্রখ্যাত অধ্যাপক Henry Hurry Goodeve (wiki) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে Dr. Bramley-এর প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন। সাথে তিনি একথাও জানিয়েছিলেন যে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাঁর কয়েকটি শর্ত মেনে নিলে তিনিও ছাত্রদের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে যেতে রাজী আছেন। Dr Goodeve সেই ব্যাপারে এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে, একজন ছাত্রের ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীন পুরো খরচ তিনি নিজেই বহন করবেন বলে স্থির করেছিলেন। সেই যুগে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অনেক মহৎ কর্মের উৎসাহ এবং অর্থ আসত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রথম থেকেই অগ্রণী ছিলেন। ১৮৭২ সালে তিনি যখন প্রথম ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন, তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’কে তিনি নিজের সঙ্গে নিতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজেন্দ্রলালের অভিভাবকদের আপত্তিতে তাঁর আর যাওয়া হয়নি। Dr Goodeve-এর প্রস্তাবে সেবারে তিনি দুজন ছাত্রের খরচ চালাতে রাজি হয়েছিলেন। আরেকজন ছাত্রের জন্য জন্য Dr Goodeve চাঁদা তুলে অর্থ ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাব ‘সৈয়দ মনসুর উল্লা খাঁ বাহাদুর’ সেই মহৎ কার্যের জন্য মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন।
১৮৪৫ সালের ১৮ই মার্চ তারিখে, Dr. Goodeve চারজন ছাত্রকে নিয়ে এস. এস. বেন্টিঙ্ক জাহাজে করে ইংল্যাণ্ড রওনা হয়েছিলেন। সেই থেকে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের ডাক্তারি পড়ার জন্য ইংল্যাণ্ডে যাওয়ার সূত্রপাত ঘটেছিল। আজও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ভারতেই M.D., M.S. করবার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও ইংল্যাণ্ড থেকে M.R.C.P., F.R.C.P. করবার আকর্ষণ এখনো যায় নি। উল্লেখযোগ্য যে প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুরও সেই একই জাহাজে করে ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন। লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে সেই চারজন ভারতীয় ছাত্র ভর্তি হয়েছিলেন। Dr Goodeve সাহেবের লণ্ডনের বাসভবনে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। Dr Goodeve একাধারে বন্ধু, গুরু এবং আত্মীয় ছিলেন। সঙ্গ দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে তিনি সেই চারজন তরুণ বাঙালীর গৃহকাতরতার যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন।
First four Indian Doctors in UK (British Museum) |
১৮৪৬ সালের ২৭শে জুলাই ভোলানাথ বসু, দ্বারকানাথ বসু এবং গোপালচন্দ্র শীল ‘এম. আর. সি. এস.’ (Member of Royal College of Surgeons) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এরপরে ১৮৪৭ সালে ভোলানাথ বসু লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘M.D.’ পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনিই লণ্ডন থেকে পাশ করা প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালী ‘M.D.’ ছিলেন। সেই সময়ের একজন বাঙালী ছেলের পক্ষে এটা কম কৃতিত্বের পরিচয় নয়। Michael H. Fisher এর "Counterflows to Colonialism: Indian Travellers and Settlers in Britain 1600-1857" বইটি থেকে জানা যায় যে ভোলানাথ বসু Botany ও Comparative Anatomy-তে সোনার মেডেল এবং Chemistry ও Materia Medica-তে রূপোর মেডেল পেয়েছিলেন। সূর্য চক্রবর্তীর বয়স কম ছিল বলে ১৮৪৮ সালের আগে তাঁকে ‘M.R.C.S.’ পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। এই সময়ে লর্ড অকল্যাণ্ড সরকারী কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে ইংল্যাণ্ডে বাস করছিলেন। ভোলানাথের কৃতিত্বে আনন্দিত হয়ে তিনি তাঁকে একটি সোনার ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
১৮৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে গুডিব সাহেবের সঙ্গে গোপালচন্দ্র শীল ও ভোলানাথ বসুও ভারতে ফিরে এসেছিলেন এবং ‘আন-কাভিন্যানটেড মেডিক্যাল সার্ভিসে’ যোগ দিয়েছিলেন। তবে বিলেতযাত্রার জন্য ভোলানাথকে জাতিচ্যুত করা হয় এবং এই কারণে দেশে ফিরে এলে আর কখনোই চানকে ফিরে আসেননি - বদলির চাকরিও ছিল চানকে না ফেরার আরেকটি কারণ। এরপরে ভোলানাথ বসু দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করেছিলেন। কলকাতা ফিরে সুকিয়া লেনের ডিস্পেন্সারিতে তিনি ছিলেন সার্জেন এবং সুপারিন্টেন্ডেট। ১৮৪৮-১৮৪৯ এর অ্যাঙ্গলো-শিখ যুদ্ধ এবং ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় কিছুকাল তিনি ব্রিটিশ আর্মির হয়ে কাজও করেছিলেন। নিজের কর্মজীবনের একটা বড় সময় ধরে তিনি ফরিদপুরের ‘সিভিল সার্জন’ পদে ছিলেন। জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন। ভোলানাথ বিবাহিত হলেও সম্ভবত সন্তানহীন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী আগেই গত হয়েছিলেন। ব্যারাকপুরে তাঁর কোন বংশধর এখন থাকেন না, ফলে এই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর সব সম্পত্তি জনগণের সেবায় উৎসর্গ করে যান - ব্যারাকপুরের ‘ডাঃ বি. এন. বোস হাসপাতাল’ তাঁরই অর্থে এবং জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।তাঁরই দানে হুগলি জেলায় তাঁর শ্বশুরালয়ের ইলাছোবামণ্ডলই গ্রামে একটি চিকিতসালয় গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
Post by Rana Chakraborty - https://tinyurl.com/5n7w7tz2
No comments:
Post a Comment