Pages

Saturday, April 15, 2023

টাকির জমিদারির ইতিহাস

পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় ইছামতী নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত মফস্সলের এই ছোট শহর - টাকি ঘিরে রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস। ইছামতী ছাড়াও আরো একটি ছোট নদী প্রবাহিত হত টাকির পাশ দিয়ে। এর ফলে তৈরি হয় সরু মুখের নদীতীর বা ট্যাঁক। এই ট্যাঁক থেকেই টাকি'র নামকরণ হয় বলে মনে করা হয়। এখানে সেই অর্থে সীমান্ত বলে কিছু নেই - নদীর মাঝ বরাবর ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। নদীর এপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার টাকি এবং অপর প্রান্তে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্রীপুর, ভাতসালা, দেভাটা গ্রাম। সুন্দরবনের গেটওয়ে হিসেবেও টাকি পরিচিত হলেও আজ কলকাতা থেকে Weekend Destination হিসেবে টাকি আলাদা করে স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধুমাত্র ইছামতীর টানেই, বা শীতের গ্রামের আমেজ নিতে বা, দশমীর দুর্গাবিসর্জন দেখতে নয়, টাকির ইতিহাসের টানে এখন ভ্রমণপিয়াসীরা আসছেন সারা বছর ধরে। যদিও টাকির ইতিহাসের অনেককিছুই এখন অবহেলায় সময় এবং নদীর গর্ভে - যা আছে তার দরকার ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ। 

টাকির জমিদারির ইতিহাস প্রায় চারশো বছরের। গৌড়েশ্বর আদিশুরের আমন্ত্রণে কাণ্যকুব্জ থেকে আগত কায়স্থ পঞ্চকের অন্যতম বিরাট গুহ ছিলেন এই রায়চৌধুরী বংশের আদিপুরুষ। মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের শেষের দিকে (ধরে নেওয়া যায় ১৬০০ সালের আশেপাশে) দুর্লভ গুহ মজুমদার টাকি-শ্রীপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন এবং এই অঞ্চল দেখভাল করা ও খাজনার হিসেব রাখার দায়িত্ব পান। তার বড় ছেলে ভবানীদাস টাকি অঞ্চল লাভ করেন অন্যদিকে তার মেজ ছেলে জগদানন্দ শ্রীপুর অঞ্চলের দায়িত্ব পান। তবে জমিদার হিসেবে ভবানীদাস রায়চৌধুরীকেই টাকির জমিদার বংশের আদি পুরুষ বলে মনে করা হয়। কিছুদিন পর ভবানীদাস টাকির পার্শ্ববর্তী কঠুর অঞ্চলের স্থানীয় জমিদার শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মেয়েকে বিয়ে করে টাকির পার্শ্ববর্তী মাইহাটির বিস্তীর্ণ অঞ্চল লাভ করেন। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে উভয়ই হিসেব নিকেশের কাজ ছেড়ে নিজেদের জমিদারি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। এসময় এরা ছিলেন সাধারণ এক মালগুজারি জমিদার, যশোরের সামন্ত ভুস্বামীদের দয়ায় ইছামতী নদীর পাড়ে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন মাত্র। এই সময় থেকেই তারা 'মজুমদার' পদবীর পরিবর্তে 'রায়চৌধুরী' পদবীর ব্যবহার শুরু করেন, যা তাদের পেশা পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করা হয়। সব মিলিয়ে মুঘল আমল থেকেই ইছামতী নদীর দুই পাড়ে রায়চৌধুরী জমিদারদের হাত ধরে এলাকাটি গড়ে উঠতে থাকে। 

রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যে আক্রমণ শানানোর জন্য টাকিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের লড়াই হয় বসিরহাটের সংগ্রামপুরে। প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে তাড়া করে মানসিংহের বাহিনী। টাকি শ্মশানের পাশ দিয়ে ইছামতী পার হয়ে রক্ষা পায় প্রতাপাদিত্যের দলবল। সেই ইতিহাসকে মনে রেখেই শ্মশান-সংলগ্ন রাস্তার নাম পরে রাখা হয় মানসিংহ রোড।

ভবানীদাসের পুত্র কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী (বিরাট গুহের অধস্তন পঞ্চাদশ পুরুষ) টাকিতে পাকাপাকি বসতি স্থাপন করেন। কৃষ্ণদাসের চেষ্টায় টাকি সম্ভ্রান্ত এবং ব্রাহ্মণ পরিবারের বাসভূমিতে পরিণত হয়। টাকির জমিদারগণ ছিলেন মূলত বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। পরে তাঁদের সঙ্গে শাক্ত ভাবধারা যুক্ত হয়। তাঁদের পারিবারিক দেবতা ছিলেন গোবিন্দদেব, এবং রাধামাধব। 

তারপর বহু উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে ভবানীদাসের পুত্র-প্রপৌত্রগণ জমিদারি পরিচালনা করেছেন। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রামসন্তোষের সময় তার চার পুত্র এই জমিদার বংশকে ভাগ করে নেয় -  দয়ারাম (পূর্ব বাড়ি), শ্যামসুন্দর (পশ্চিমবাড়ি), রামকান্ত (দক্ষিণবাড়ি/মুন্সীবাড়ি), গোবিন্দ (উত্তরবাড়ি)। 

উত্তরের আটচালা জমিদার বাড়ি অনেক কাল আগেই ভগ্নপ্রায়। সেখানেই ১৯৯০ সালে গড়ে উঠেছে নৃপেন্দ্র অতিথিশালা। এই গেষ্টহাউসটির দায়িত্বে আছেন টাকি পুরসভা। উত্তরের বাড়ির ইতিহাস বিশেষ জানা যায় না। গোবিন্দপ্রসাদ রায়চৌধুরী ছিলেন এই বাড়ির প্রথম পুরুষ। 

দক্ষিণের বাড়ি/মুন্সী বাড়ি ~~

টাকির দক্ষিণের জমিদারবাড়িকে মুন্সীবাড়ি বলা হত কারণ রামকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চিফ সেক্রেটারী বা মুন্সী। তবে এই উত্থান এত সহজ ছিল না। জমিদার-পুত্র হয়েও রামকান্ত সেই অর্থে ধনীর দুলাল ছিলেন না। তাঁর বাবার আমলেই এই জমিদারবাড়ি চার শরিকে ভাগ হয়ে যায়। পরিবারের ছোট ভাইদের ও বিধবা মাকে টাকিতে এক আত্মীয়ের বাড়ী রেখেই রামকান্ত চলে যান ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় - তখন কলকাতায় সবেমাত্র ব্রিটিশ জমানা শুরু হয়েছে। ১৭৬১ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কম্পানীর দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের সেরেস্তার কর্মচারী হিসাবে রমাকান্ত নিযুক্ত হন। এরপর ব্রিটিশ গর্ভনর হন ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৫)। তিনিই সংস্কৃত, উর্দু, পার্শীতে পারদর্শী রামকান্তকে মুন্সী হিসেবে নিয়োগ করেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর মুখ্য দলিল নির্মাতা হয়ে রামকান্ত একে একে উত্তরবঙ্গ, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কম্পানির হয়ে পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত শুরু করে দিলেন । ১৭৭৩ সালে কোচবিহার, গোরক্ষপুর, নাগপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যকে ব্রিটিশ শাসনের আংশিক অঙ্গীভূত করার কৃতিত্বও তার । জমি বন্দোবস্তের অভিজ্ঞতা থাকায় লর্ড কর্ণোয়ালিশ ও স্যর জন শোর তাকে ভারতের বোর্ড অফ রেভিনিউ এর অন্যতম সদস্য মনোনিত করেন । তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনেও যথেষ্ঠ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির একজন একনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে প্রচুর টাকা উপার্জন করে দেশে ফিরেছিলেন তিনি । 

এই সময় থেকেই টাকি আর কলকাতার মধ্যে এক দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রামকান্তের সাথে সম্ভবত শোভাবাজার রাজবাড়ীর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে তাঁর আমল থেকেই টাকিতে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। অনেকের মতে টাকিতে জমিদারী প্রতিষ্ঠার আদিকাল থেকেই এই দুর্গাপূজা হয়ে আসছে, অর্থাৎ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকে। সেই হিসাবে এই পূজার বয়স প্রায় 400 বছর। তবে তার জৌলুস কতখানি ছিল সেবিষয়ে সন্দেহ আছে। 

রামকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র গোপীনাথ ছিলেন তৎকালীন হিন্দুসমাজের নেতৃস্থানীয়। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

রামকান্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীনাথের পুত্র ছিলেন কালীনাথ রায়চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন উদার, সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পন্ন জমিদার। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর সক্রিয় অবদান ছিল। কালীনাথ রায়চৌধুরী রাজা রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ট, এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্ম ভাবধারা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন, কিন্তু শাক্ত ভাবধারায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এক সময়। রাজা রামমোহন রায়ের পরামর্শে এবং খ্রিস্টান মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফের পরিচালনায় জমিদার কালীনাথ ১৮৩২ সালের ১৪ জুন টাকিতে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্থাপন করেন। তার চেষ্টায় টাকিতে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটে। ১৮৫১ সালে টাকি সরকারী স্কুল ও ১৮৬২ সালে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন হয়। 

টাকির কাছেই ইছামতী নদীর তীরে সোলাদানার বাগুন্ডিকে (আজকের বসিরহাট) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছিল। ১৮২২ সালে সেখানকার সেরেস্তাদার (নিমকি দেওয়ান) হয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। কলকাতার বরাহনগর ঘাট থেকে ইছামতী নদীপথে বাগুন্ডিতে ব্যবসার কাজে এলে দ্বারকানাথকে সাজানো বজরায় করে বাড়িতে নিয়ে যেতেন টাকির জমিদার মুন্সি কালীনাথ রায়চৌধুরী। অনেক পদস্থ ব্রিটিশ কর্তারাও তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করতেন। 

কালীনাথের বাড়িতে দুর্গাপুজো জাঁকজমকের নতুন দিগন্ত স্পর্শ করেছিল। সেকালের পুজোর আবহ ছিল একেবারে অন্যরকম। পুজোর কদিন আগে থেকেই দেবী দুর্গার আগমনবার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য গায়করা আগমনী গান গেয়ে বেড়াতেন। পুজোর এই কদিন টাকি সেজে উঠত নতুন সাজে। কোলকাতার আদলে রাস্তায় জ্বালান হতো গ্যাসের বাতি। বাজি ও তুবড়ি আনা হতো কোলকাতা থেকেই। প্রায় প্রতি রাতেই যাত্রা ও বাঈজি নাচের আসর বসত। বিভিন্ন ঝাড় লন্ঠনের আলোয় নাচের আসর উজ্জ্বল হয়ে উঠত। কালীনাথ রাজবেশ পরে আসরে ঢুকতেন, সমবেত ব্যক্তিরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাতেন। 'সোলাদানার নিমকচোকি'র সাহেবরাও এই উৎসবে আমন্ত্রিত হতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর বহুবার এই আসরে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকেছেন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান কালীনাথ। তিনি কিছু আখড়াই, হাফ আখড়াই, আগমনী গান রচনা করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের বই পার্সি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন এই মানুষটি। কালীনাথের উদ্যোগেই সোলাদানা থেকে বারাসাত পর্যন্ত ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রায় দশ বছর ধরে রাস্তা তৈরি হয়েছিল। গান লেখা হয়, 'ধম্ম অবতার এখন বাবু কালীনাথ/নতুন রাস্তা দিলে, সোলাদানা-বারাসাত'। পরবর্তীকালে রাস্তাটিরই নাম হয় টাকি রোড

Source: Facebook/Internet

এই দক্ষিণের জমিদারবাড়িকেই অনেকে রাজবাড়ী বলে থাকেন। রাজবাড়ি বলে আজকের এই জনপ্রিয়তার একটি কারণ পর্যটন, এবং স্থানীয় পুরসভাও সেটিকে প্রচার করে চলেছে। তবে আজকে এই বাড়ির অধিকাংশই ইছামতীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। 

পুবের বাড়ি ~~

সুপ্রাচীন বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম টাকি পুবের বাড়ির দুর্গাপুজো। 

পুবের বাড়ির দুর্গা দালান

পুবের বাড়ির প্রথম পুরুষ ছিলেন দয়ারাম, যদিও তাঁর পুত্র কমলাকান্তের আমল থেকে সম্বৃদ্ধি শুরু হয়। টাকি ছেড়ে অল্প বয়সেই কলকাতা গিয়ে কিছুদিন কোম্পানির অধীনে চাকরি  করেন। এরপর প্রথমে আজমগরের ছোট দেওয়ান,পরে গোরক্ষপুরের দেওয়ান নিযুক্ত হন। মারাঠা দস্যুদের কবল থেকে কাশী(বারাণসী)কে রক্ষা করার জন্য তিনি রাজাকে পরামর্শ দেন সমগ্র রাজ্যকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার। চলাচলের জন্য কয়েকটি ফটক বা 'গেট' থাকবে। এই ব্যবস্থায় ডাকাতের কবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে কাশী রাজ খুশি হয়ে একটি ফটকের নামকরণ করেন কমলাকান্তের নামে - "কমলা পতিকা ফটক" । তিনি দেওয়ানী মারফত প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে তা দিয়ে চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, যশোহর-খুলনা প্রভৃতি জেলায় জমিদারি কেনেন।

কমলাকান্তের পুত্র ছিলেন শ্রীকান্ত রায় চৌধুরী। তাঁর সু্যোগ্য পুত্র সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী (জন্ম ১৮৬২) ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। কমলাকান্তের বানানো পুবের জমিদার বাড়িটি ইছামতী নদীর ভাঙ্গনে বাসের অযোগ্য হলে সূর্যকান্ত বর্তমান অট্টালিকাটি নির্মাণ করেন (১৯৩০ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়)।

শরিকি ঝামেলা এড়াতে সূর্যকান্ত খুব বেশি টাকিতে থাকেননি (absentee landlords) কিন্তু তিনি টাকিতে বহু জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। টাকিতে আজ যে হাসপাতাল, এরিয়ান ক্লাব, পৌরসভা সবই পুবের বাড়ীর জমির ওপর নির্মিত। শুধু টাকি নয়, বসিরহাট টাউনহল ও তৎসংলগ্ন পার্কটিও তাঁর তৈরী। পানীয় জলের সংকট মেটাতে সূর্যকান্তের উদ্যোগেই খনন করা হয় বর্তমান রবীন্দ্রভবন সংলগ্ন পুকুরটি। পার্কটি আজও সূর্যকান্ত পার্ক নামে প্রসিদ্ধ। বসিরহাট বাজারটিও সূর্যকান্তের উদ্যোগে নির্মিত। তিনি বারাণসীতেও পিতার নামে "শ্ৰীকান্ত চতুষ্পাঠী" প্ৰতিষ্ঠা করেন।

বিলাস বৈভবেও এদের খ্যাতি ছিল অতুলনীয়। সূর্যকান্ত রায় চৌধুরীর পুত্র জগবন্ধুর বিবাহে বত্রিশ ঘোড়ায় টানা গাড়ি ভাড়া করা হয়। এত লোক বর যাত্রী হয়ে গিয়েছিল যে, সার্কুলার রোড আধ ঘন্টার জন্য বন্ধ রাখতে হয়।এজন্য চার্লস টেগার্ট-এর অনুমতি নিতে হয়েছিল। সূর্যকান্তের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে 'মহা দানসাগর' আয়োজিত হয়। ব্রাহ্মণদের দান করা হয় একটি করে হাতি,ঘোড়া,গরু,নৌকা,পালকি এবং ষোল সেট খাট বিছানা ও রুপোর বাসন।এঁদের পরিবারের কাহিনী নিয়েই প্রখ্যাত সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রচনা করেন জনপ্রিয় উপন্যাস "পরকপালে রাজারানী"।

সূর্যকান্ত রায় চৌধুরী তাঁর ছেলে জগবন্ধুর বিবাহ উপলক্ষ্যে শিয়ালদহে আপার সার্কুলার রোডে একটি বাড়ি ভাড়া নেন। তাঁর সেই বাড়িটি এতই ভালো লেগে যায় যে ওই বাড়িটি সহ পাশের জমিটিও কিনে নেন। এইভাবে ১৯৫৬ সালে টাকির জমিদারের কলকাতার 'টাকি হাউস' তৈরি হয়। পরবর্তীকালে বিধান চন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভার সদস্য হন এই রায় চৌধুরী জমিদার বংশের হরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। তিনি পরে শিক্ষামন্ত্রী হলে এই 'টাকি হাউস'টিকে একটি স্কুল স্থাপন করার কথা বলেন। ১৯৬৫ সালে এই স্কুল চালু হয়। টাকি বয়েজ (এখন নাম Govt. Sponsored Multipurpose School for Boys') স্কুলের প্রথম প্রধানশিক্ষক ছিলেন কানাইলাল মুখোপাধ্যায়। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছেই এই টাকি বয়েজ এর ঠিকানাঃ ২৯৯বি, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, রাজাবাজার, কলকাতা - ৭০০ ০০৯। ২০১৮ সালে টাকি বয়েজ স্কুল মধ্য কলিকাতা বালিকা বিদ্যালয়টিকে অধিগ্রহণ করে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের সূচনা করে। 

বসিরহাটের সংগ্রামপুরের দক্ষিণাকালী মন্দিরটিও সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী নিজের খরচে প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায় নদীয়ার রাজা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র (১৭১০ – ১৭৮৩) সপারিষদ নৌকাভ্রমণে বেরিয়ে বসিরহাটের সংগ্রামপুরের কাছে ইছামতীতে নৌকা নোঙর করেন। রাতে স্বপ্নাদেশ পেলে রাজা পরদিন সকালে রাজা সংগ্রামপুরের জঙ্গলে ঢুকে এক জায়গায় কালীমায়ের পুজোর থান দেখতে পান। তারপর রাজা তাঁর পারিষদদের ওই স্থানে মন্দির তৈরির নির্দেশ দেন। কালের নিয়মে সেই মন্দির ভেঙে পড়লে টাকির রায়চৌধুরী পরিবারের জমিদাররা সেখানে কাছারিবাড়ি তৈরি করেন। ওই কাছারীর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা বাচস সর্দার। একদিন বাচস স্বপ্নাদেশ পান। মা স্বপ্নে তাঁকে ওখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এরপর টাকির জমিদার সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী  শ্যামাচরণ চক্রবর্তীর পৌরহিত্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। অত্যন্ত জাগ্রত এই মন্দিরে শ্যামাপুজো, পৌষকালী পুজো, ভদ্রকালী পুজো এবং চরকের মেলা জাঁকজমক করে উদযাপিত হয়। শ্যামাপুজার দিনে মন্দিরের এক মাইলের মধ্যে প্রতিমা গড়ে কালীপুজা করার নিয়ম নেই। এই মন্দিরে এখনো মাটির হাঁড়িতে ভোগ রান্না করার রীতি রয়েছে। ভোগ বলতে মটর ডাল, কচুর মুখি আর এঁচোড়-চিংড়ির সঙ্গে সাদা ভাত। 

সূর্যকান্তের পুত্র জগবন্ধু রায়চৌধুরীর আমলে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটে ফলে এই জমিদারির বেশিরভাগ সম্পত্তিই সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। তা সত্বেও মূল জমিদারবাড়ীটি এখনও টিঁকে আছে। জগবন্ধুর স্ত্রী নমিতা রায়চৌধুরীর উদ্যোগে বাড়ীটা দেবোত্তর সম্পত্তিতে পরিণত হয়, যেকারণে প্রতিবছর নিয়মমেনে এবং বাধ্যতামূলকভাবে সাবেকি প্রথায় দুর্গাপূজা করা হয়। সেই ধারা বছরের পর বছর ধরে বজায় রেখে চলেছেন উত্তরসূরিরা। ২০২২ সালে এই পুজো ৩০০ বছরে পড়ল। আজ আর নেই সেই ঝাড়বাতির রোশনাই। তবুও প্রাচীন রীতি মেনে আজও সাবেকিয়ানায় মোড়া জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো। সেই একচালের ডাকের সাজে প্রতিমার চল রয়েছে এখনও। পুরোহিত, মৃৎশিল্পী, ঢাকি সবাই বংশপরম্পরায় কাজ করে আসছেন। এখানকার মূর্তি ঢাকেশ্বরী রীতিতে নির্মাণ করতে কৃষ্ণনগর থেকে পাল বংশের বিখ্যাত মৃৎশিল্পীরা আসতেন। পরে জমিদাররা এদের টাকিতেই জমি দিয়ে বসতি স্থাপন করিয়ে দেন। তাঁরা আজ এখানকারই বাসিন্দা হয়ে গেছেন।

দুর্গাপুজোয় কামান দাগা হত, ১০৮টি পাঁঠা ও ১টি মহিষ বলি হত। শতাব্দী প্রাচীন হাঁড়িকাঠ, খাঁড়া এখনও আছে। তবে ২০১৮ সাল থেকে পশুবলি প্রথা বন্ধ করা হয়েছে। এখন অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় চালকুমড়ো বলি হয় ওই হাঁড়িকাঠে। একচালা প্রতিমা হয়। রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানেই ঠাকুর তৈরি করা হয়। পঞ্জিকার সময় অনুৃযায়ী প্রথামাফিক সিঁদুর খেলার পর পুবের বাড়ির দুর্গা প্রতিমা ২৪ জন বেয়ারার কাঁধে চেপে রাজবাড়ি ঘাটে যায়। তারপর টাকির বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে প্রতিমা বেরোয়। প্রতিমা নিরঞ্জন হয় দু’টি নৌকোর মাঝে, বাঁশের উপরে প্রতিমা বসিয়ে। দু’টি নৌকা দূরে সরে যায়, প্রতিমা পড়ে জলে। বিসর্জন শেষে প্রথা মেনে পান্তা ভাত, কচু শাক, আলু চকা ও মিষ্টি খাওয়ানো হত। এখন কামানের বদলে বাজি পোড়ানো হয়।

বছর চারেক আগে টাকির ‘পুবের বাড়ি’ লিজ়ে নেন কলকাতার এক পর্যটন ব্যবসায়ী। ঝিমিয়ে পড়া বাড়ির দুর্গাপুজোকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে। পুজোর চারদিন সবার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভগ্নপ্রায় পুবের বাড়ির পুরনো কাঠামো বজায় রেখে জমিদার বাড়ির ধাঁচে ঝাঁ চকচকে করে তোলার পরিকল্পনা আছে। বাড়ির আশপাশে যে ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানেও পুরনো জমিদার বাড়ির ধাঁচে একাধিক কটেজ গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানের সামনের পুরনো পুকুর সংস্কার করে পর্যটকদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হবে। ইতিমধ্যে হেরিটেজ আরকিটেক্ট ডিজ়াইনারদের পরামর্শ মতো শুরু হয়েছে পরিকল্পনা। ব্যবসায়ী পরিবারের তরফে শর্মিষ্ঠা ঘোষ জানালেন, এখানে এমন ভাবে নির্মাণ কাজ করা হবে, যাতে পর্যটকেরা দুর্গাপুজোয় এলে অনুভব করেন, হোটেলে নয় - বরং প্রাচীন জমিদার বাড়িতে পুজো কাটাতে এসেছেন।  


পশ্চিম বাড়ি ~~

টাকির জমিদারদের পশ্চিমবাড়ির প্রথম পুরুষ ছিলেন শ্যামসুন্দর রায়চৌধুরী। তাঁর ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বর্তমানে এই পশ্চিমবাড়িটিও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই বাড়ির পুজোর দালানের অংশবিশেষ এখন হেরিটেজ গেষ্ট হাউসের সামনে দেখতে পাওয়া যায়।

 শ্যামসুন্দরের পুত্র জমিদার বিশ্বনাথ রায়চৌধুরী ছিলেন পত্তনি প্রথার উদ্ভাবক, বর্ধমান রাজের দেওয়ান হিসাবে তিনি এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বিশ্বনাথের প্রণালীর অনুকরণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৯ সালের আট আইন (Regulation VIII of 1819) প্রবর্তন করেন। 

তারাশংকর রায়চৌধুরী টাকিতে প্রথম আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। 

পশ্চিমবাড়ির ডাঃ অজিত কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত, বেলুড় মঠের দ্বিতীয় সভাপতি স্বামী শিবানন্দজীর শিষ্য। তিনি টাকিতে প্রথম দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন। গুরুর নামে সেই চিকিৎসালয়ের নাম দেন স্বামী শিবানন্দ সেবাশ্রম, যেটাকে আমরা পুরনো হাসপাতাল বলে চিনি। অজিতবাবুর চেষ্টাতেই তাঁদের পশ্চিমের বাড়িতে ১৯৩১ সালের ১লা জানুয়ারি 'শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সঙঘ' স্থাপিত হয়। শুরুতে একটি প্রাইমারি স্কুলই ছিল যেখানে ক্লাস ফোর অবধি পড়ানো হত। এর পরে সুবোধ কৃষ্ণ দাসের প্রাইমারি স্কুল এবং ফণীভূষণ ঘোষের লোয়ার প্রাইমারি স্কুল 'শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সঙঘ'-এর সাথে যুক্ত হয়। গঠিত হয় টাকি শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সঙঘ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৩২ সাল নাগাদ টাকির বাসিন্দা রামকৃষ্ণ কুণ্ডু দুই বিঘা জমি দান করেন, তখন আজকের জায়গায় স্কুলটি উঠে আসে। ১৯৩৮ সাল নাগাদ বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের থেকে অনুমোদন পায় এবং 'টাকি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম' বলে পরিচিত হয়। অন্যান্য মিশন স্কুলের মতোই সুন্দর পরিবেশ এখানে। ছিমছাম, পরিষ্কার আশ্রম প্রাঙ্গণের ডানদিকে স্কুল আর বাঁদিকে মিশনের অফিস ঘর। আর গেটের একদম সোজাসুজি প্রার্থনা গৃহ। প্রবেশ পথের দুপাশ ফুলগাছে সাজানো।

অত্যন্ত সফল আইনজীবী ও রাজনীতিক সনৎকুমার  রায়চৌধুরী ১৯৩৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র এবং ১৯৩৭ সালে মেয়র পদ অলংকৃত করেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসাবে তাঁর আনা প্রস্তাবের উপর  ভিত্তি করে বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষিত হয়। 'হিন্দু সৎকার সমিতি'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। সনৎবাবুর বাবা ছিলেন ভবনাথ রায়চৌধুরী।  টাকির ভবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় সনৎবাবুরই প্রতিষ্ঠা। 

এই বাড়ির স্যার অশোককুমার রায় ছিলেন টাকির একমাত্র স্যার বা নাইটহুড উপাধির বিরল সম্মানের অধিকারী। আইনে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে  Knighthood বা 'স্যার' উপাধি প্রদান করেন। স্থায়ী এডভোকেট জেনারেল এবং দু'বার হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসাবে কাজ করেন। টাকির জমিদারদের মধ্যে ইনি একমাত্র বিলেত ফেরৎ। কালাপানি পার হওয়ার 'অপরাধে' তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। 

পশ্চিমবাড়ি (অর্কিড ক্লাবের বিপরীতে) প্রাঙ্গণে, টাকি মাউণ্ট জিওন ইংলিশ মিডিয়াম সেকেণ্ডারি স্কুলের সামনে আছে ভাষা শহীদ মিনার। ২০০১ সালে টাকি পুরসভা এই মিনারটি স্থাপন করেন। মিনারের তলদেশে নকশা ও লেখার ধারণা দেন মুকুল রায়চৌধুরী। প্রতি বছর  টাকি পৌর নাগরিক সমিতির উদ্যোগে ও পরিচালনায়, টাকি পৌরসভার সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি এখানে ভাষা দিবস অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়ে থাকে।


ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজো ~~

এই পুজোই এখন ঘোষবাড়ির একমাত্র পরিচয় কিন্তু এঁরাও ছিলেন বর্ধিষ্ণূ টাকির অংশ। 

ঘোষবাড়ির দূর্গাদালান

মনে করা হয় ঘোষেরা এই এলাকায় রায়চৌধুরী জমিদাররা আসার অনেক আগে থেকেই এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এই এলাকায় টাকি ও নিকটবর্তী সৈদ্পুর, বেঁওকাটি, জালালপুর অঞ্চলে ঘোষরা বসবাস করতেন। রায়চৌধুরী জমিদাররা ছিলেন কুলীন কায়স্থ, ফলে টাকিতে পদার্পনের পর তাদের সন্তান সান্ততির বিবাহের জন্য কিছু পাল্টি ঘরের প্রয়োজন ছিল। কায়স্থ ঘোষরাই এর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটায় । ভবানীদাসের সাথে বিয়ে হয়  শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মেয়ের। কালক্রমে ঘোষদের মতোই বোস ও কুন্ডুরা রায়চৌধুরীদের পালটি ঘর হিসাবে পরিচিত হয় । এবং টাকির যাবতীয় কায়স্থ বিবাহকার্য রায়চৌধুরী, ঘোষ, বোস, ও কুন্ডুদের মধ্যে সম্পন্ন হতো। রায় চৌধুরী জমিদারদের প্রভাব প্রতিপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে বাড়তে শুরু করলেও ঘোষবাবুরা কিন্তু মুঘল সনাতনী জমিদারী ব্যবস্থাই বলবৎ রেখেছিলেন, অর্থাৎ চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে নব্য জমিদার হয়ে শহুরে হয়ে ওঠার হিড়িক তাদের মধ্যে দেখা যায়নি । গ্রামীণ পরিমণ্ডলেই তারা বিত্তশালী সম্প্রদায় হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন । কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হরিনারায়ণ ঘোষের আমলে। 

প্রায় ৩০০ বছর আগে হরিনারায়ণ ঘোষ এই পুজোর সূচনা করেন। অবিভক্ত বাংলার খুলনায় এই ঘোষদের জমিদারি ছিল। হরিনারায়ণ ঘোষ ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার (মনসদে ১৭৫৬-১৭৫৭) জজ বা দেওয়ান। পলাশী যুদ্ধের পর হরিনারায়ণ লর্ড হার্ডিঞ্জ (কার্যক্রম ১৭৭৩-১৭৮৫) ও লর্ড ডালহৌসির আমলে চব্বিশ পরগনা জেলার 'সদর আমিন আলা' পদে নিযুক্ত হন এবং কর্মদক্ষতার গুনে ডালহৌসি কর্তৃক 'রায়বাহাদুর' আখ্যায় ভূষিত হন। সেইভাবে দেখলে কোনভাবেই ঘোষবাবুর পুজো ৩০০ বছর ছুঁতে পারেনি এখনো। 

(প্রসঙ্গত, অমৃত বাজার পত্রিকার কর্ণধার শিশিরকুমার ঘোষের বাবার নামও ছিল হরিনারায়ণ ঘোষ। ইনি যশোরের উকিল ছিলেন। তবে এই দুই হরিনারায়ণ ঘোষ এক ব্যক্তি ছিলেন না।) 

হরিনারায়ণের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন প্রসন্নচন্দ্র ঘোষ। তিনি ছিলেন একজন সুকবি । বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রিয়শিষ্য ছিলেন তিনি । সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার লেখক ছিলেন তিনি । তার পৌত্র প্রসূনচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও কোলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট। টাকির নানা সমাজকল্যাণ মূলক কাজে তার যথেষ্ঠ ভূমিকা আছে। পরবর্তীকালে টাকিতে প্রতিষ্ঠিত টাকি সন্মিলনীর সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। 

ঘোষবাড়ির শচীন্দ্রনাথ ঘোষ, হিরণচন্দ্র ঘোষ, প্রতীকচন্দ্র ঘোষ, প্রসূন ঘোষরা একসময় এক বছর অন্তর শাক্ত মতে পাঁঠা বলি দিয়ে পুজো করতেন। কুমারী পুজো ঘোষদের দুর্গাপুজোর সাথে অঙ্গাঙ্গী ছিল। এই পুজোয় কোন ভোগ রান্না হত না - দেবীকে নিবেদন করা হয় কাঁচা খাদ্যদ্রব্য। 

পরে এই বংশের মতিলাল ঘোষ বৈষ্ণব ধর্ম নিলে বৈষ্ণব মত অনুযায়ী আখ ও চালকুমড়ো বলি শুরু হয়। সেই প্রথা আজও চালু রয়েছে। সাহসী মতিলাল লাঠি খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। একবার ডাকাতদের লড়াইয়ে হারিয়ে ৬-৭ জন ডাকাতকে বেঁধে টাকিতে নিয়ে আসেন তিনি। তখন থেকেই প্রবাদ চালু হয় "টাকির লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি ও গোবরডাঙ্গার হাতি"।

সেসময়ে ঘোষদের বাড়িতে পুরসভার এক অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। এখানে ঘোষদের আমন্ত্রণে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আসেন। শোনা যায় একসময় এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বোস এসেছিলেন।

আজ ঘোষেদের সেই পুরোনো দুর্গাদালানের খিলানে খিলানে অবহেলা ও অযত্নের ছোঁয়া স্পষ্ট। পলেস্তারা খসা দেওয়াল আর ভেঙ্গে পড়া ছাদ নিয়ে এই ঠাকুরদালান অনেক ইতিহাসের স্মৃতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই ঘোষবাবু পাড়ার অনেকটাই ছিল ঘোষেদের জমিদার বাড়ি - এখন সেই জমির বেশিরভাগটাই বিক্রি হয়ে গেছে। শোনা যায় এই দূর্গাদালানের তলায় সুড়ঙ্গ আছে, যেগুলি দিয়ে বাংলাদেশ যাওয়া যেত। এখন এখানে ঢুকতে ১০টাকার প্রবেশমূল্য লাগে। 

এখন টাকিতে বনেদি পুজোবাড়ি হিসেবে টিকে আছে মাত্র কয়েকটাই। শঙ্কর রায়চৌধুরী, জমিদারদের পূবের বাড়ি, এবং ঘোষবাবুর বাড়িতে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে পুজো হয়। এক সময়ে এই সব জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোয় বলির জন্য বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে নৌকো ভর্তি করে ছাগল আসত। মার্টিন রেলে করে মহিষও আনা হত। পুজো দেখতে সে সময়ে সুন্দরবন এলাকা-সহ শহর কলকাতা থেকেও মানুষ আসতেন এই এলাকায়।

শঙ্কর রায়চৌধুরীর আদিবাড়ির দূর্গা দালান


টাকির দুর্গাপুজো - জমিদার বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারী পুজো

বাংলায় দুর্গাপুজো কে শুরু করেছিলেন বলা খুব মুশকিল কারণ দুর্গাকে আগে বাসন্তীঠাকুরের পুজো হিসেবে বসন্তকালেই পূজা করা হত। শরৎকালের এই দূর্গাপুজো হল অকাল বোধন। অনুমানিক ১৫০০ শতকেই বাংলায় দূর্গাপুজো শুরু হয়। হতে পারে একই সময়ে অনেকেই এই পুজো শুরু করেন। এরা সকলেই প্রায় জমিদার বা সমাজের ধনী ব্যক্তি ছিলেন। বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো কে করেছিলেন এই প্রসঙ্গে যাঁদের নাম আসে - দিনাজপুর মালদার জমিদার (তবে এই উত্তরবঙ্গের আদি দূর্গার রূপ অন্যরকম ছিল। লোকমুখে শোনা যায় এই বাড়ির দেবীর বাহন হচ্ছে সাদা বাঘ এবং সবুজ সিংহ। অন্যদিকে দেবীর চোখ হচ্ছে গোলাকার।), তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ (১৫৮০), নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোন্নগরের আশুতোষ ঘোষাল (১৪৫৪), চন্দননগরের খলিসানিতে করুণাময় বসু (১৫০৭) প্রমুখ। আবার রাঢ় বঙ্গে রাজা জগৎমল্ল (রাজত্বকাল ৯৯৪ থেকে ১০০৭) প্রথম দুর্গাপুজো করেন বলে মনে করা হয়। ছোট করে বললে এই ইতিহাস এখন সময়ের ধুলোয় অস্পষ্ট। 

টাকিতে প্রথম দুর্গাপুজো অবশ্যই রায়চৌধুরী জমিদার বাড়িতেই হয়েছিল। প্রথম দিকে এই পুজো ছিল ঘরোয়া এবং গ্রামের লোকের খুব বেশি প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে দুর্গাপুজোর জাঁকজমক শুরু হয় রামকান্ত মুন্সীর সময় থেকে, যা তুঙ্গে ওঠে তাঁর প্রৌত্র কালীনাথ মুন্সীর সময়ে। কলকাতার বাবু কালচারের সমান তালে এই মুন্সীবাড়ির পুজো বিখ্যাত ছিল। কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাঙালীরা যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় অফিসাররাও এই পুজোতে আমন্ত্রিত থাকতেন। পাল্লা দিয়ে পুবের বাড়িতেও দুর্গাপুজোর আড়ম্বর বাড়তে থাকে।

টাকির দুর্গাপুজোয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ধর্ম ছাপিয়ে বাঙ্গালীর দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক সামাজিক অনুষ্ঠান। পুজোর আগে আগমনী গানের রেওয়াজ ছিল। এখনকার মত থিমের প্রতিমা যদিও হত না, ডাকের সাজের ঠাকুরই সব মণ্ডপে দেখা যেত। এই সময় পুজোবাড়িতে নাচ-গানের আসর বসত। পুতুল নাচ ছিল এইসব আসরের অন্যতম আকর্ষণের দিক। একবার বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার পুত্র মাধব ময়রা টাকি বাজারে কবিগান গেয়ে আসর মাত করে দিয়েছিলেন। জমিদার বাড়ি থেকেই এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হত। আর থাকত দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা - এই ক'দিন টাকির মানুষের ঘরে রান্না বন্ধ থাকত। ইছামতী নদীতে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় প্রতিমাগুলিকে নৌকায় চাপিয়ে নদী বক্ষে ঘোরানো হত এবং তারপর মাঝনদীতে বিসর্জন হত। এই অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় করত ইছামতীর দুই পাড়ের মানুষ। তখন থেকেই এই অঞ্চলের দুর্গা পূজার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হয়ে ওঠে বিজয়া দশমীর দিন ইছামতী নদীতে দুর্গা প্রতিমার ভাসান।

বিজয়াদশমীতে ইছামতী নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন (ছবি - সংগৃহীত)

এখন সেই দিন নেই, সেই জমিদারও নেই। তবে টাকি আছে টাকিতেই। দুর্গোৎসবের জাঁকজমকের দায়িত্ব এখন বিভিন্ন ক্লাবগুলির উপর। তারাই টাকির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। যেমন পশ্চিম বাড়ীর পুজোর দায়িত্বে আছে বর্তমানে অর্কিড ক্লাব। বিংশ শতকে বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্র ধরে এই অঞ্চলে শরীরচর্চার জন্য ব্যয়ামাগার ও শক্তির আরাধনা শুরু হয়। এবং স্থানীয় স্তরে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলির উদ্যোগে বারোয়ারী দুর্গাপুজোর চল শুরু হয়। 

এই বারোয়ারী পুজোর একটি ইতিহাস আছে। বারোজন বন্ধু মিলে প্রথমবার এই পুজো শুরু করেছিলেন বলে এমন নাম। ১৭৯০ সালে ১২ জন মিলে একসঙ্গে একটি পুজো শুরু করেন গুপ্তিপাড়ায়। এই পুজোটাকে বলা হতো বারো পল পুজো। কলকাতার প্রথম বারোয়ারী পুজোর আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটেছিল ১৯১০ সালে, স্থানীয়দের সাহায্যে বাগবাজারে সনাতন ধর্মতসাহিনি সভা এই পুজো শুরু করেন। 

জমিদারদের উদ্যোগের বাইরে এসে টাকিতে প্রথম সার্বজনীন দুর্গোৎসব হয় মহাকালী নাট্য সমাজ ও শক্তি সংঘের (বর্তমান থুবা ব্যয়াম সমিতি, প্রতিষ্ঠা ১৯৩২) ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। এরপর একে একে বিপ্লবী সংঘ, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, যুবগোষ্ঠী প্রভৃতি ক্লাবের পূজা সার্বজনীন দুর্গোৎসবকে একটা বৃহত্তর রূপ দেয়। জমিদার বাড়ির পাশাপাশি এই সমস্ত ক্লাবগুলি বিজয়ার দিনে ইছামতী নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জনে অংশ নিত। পরে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর ক্লাবের পুজোগুলি এই এলাকার মূল পুজোয় পরিণত হয়। জমিদারদের প্রথাগত ডাকের সাজ, বা বনেদি আচার অনুষ্ঠানের বদলে গুরুত্ব পায় আধুনিকতা, থিম ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ।

টাকি এবং শ্রীপুর শহরের বিভিন্ন পূজা মন্ডপ কমিটির উদ্যোগে বিজয়া দশমীর দিন ইছামতী নদীবক্ষে প্রতিমা নিরঞ্জনের রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এই দিন কয়েক ঘন্টার জন্য আন্তর্জাতিক সীমানা খুলে দেওয়া হতো এবং কোন পাসপোর্ট ছাড়াই এপারের মানুষ ওপারে যেতে পারত। শ্রীপুরের মানুষ ঘুরে দেখতো টাকিকে, অন্যদিকে টাকি শহরের অনেক মানুষ একবার দেখে আসার চেষ্টা করত তাদের পূর্বপুরুষের বাসস্থান। কিন্তু প্রতিরক্ষা, অনুপ্রবেশ ও কূটনৈতিক সমস্যা নানা কারণে ২০১২ সাল থেকে বিজয়ার দিন এই অবাধ পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। বিএসএফ ও বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) উভয়ের কড়া নজরদারির মধ্যে প্রতিমা নিরঞ্জন চলতে থাকলেও বিজয়ার সেই উচ্ছ্বাস আজ অনেকটা ম্লান হয়ে এসেছে। 


টাকির রেলপথের ইতিহাসও বেশ পুরনো 

১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্টিন কোম্পানির ট্রেন ছুটতে শুরু করে বারাসাত-বসিরহাট লাইনে। ১৯০৯ সালে সেই লাইন চিংড়িহাটা (হাসনাবাদ) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ১৮৯৬ সালে বারাসাত-বসিরহাটের মধ্যে ন্যারো গেজ রেল লাইন চালু হয়। ১৯৫৫ সালের ১ জুলাই মার্টিন রেল বন্ধ হয়ে যায়। দেশভাগের আগে এই রেলপথই ছিল মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পরিবহণের মাধ্যম। পরে জনগণের প্রবল বিক্ষোভের জেরে ২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৭৪ কিলোমিটার ব্রড গেজ লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯৬২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বারাসাত-হাসনাবাদ প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালু হয়। ১৯৮৩ সালের ১৩ মে হাসনাবাদ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন শিয়ালদহ থেকে দমদম-বারাসাত হয়ে ইলেকট্রিক লোকাল ট্রেন যাচ্ছে সোজা হাসনাবাদ। হাসনাবাদের ঠিক আগের ষ্টেশন হল টাকি রোড। 


আরো টাকি -

  • টাকির জমিদারদের রমরমা শুরু হয় বিভিন্ন দেশীয় রাজা বা ব্রিটিশদের দেওয়ানদারি করেই। রামকান্ত মুন্সী থেকে কালীনাথ মুন্সী সবাই ব্রিটিশদের অনুগত না হলেও খুবই কাছের লোক ছিলেন। এই প্রসঙ্গেই নাম নেওয়া হয় টাকির জমিদার বংশের এক সন্তান যতীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য। 1905 সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মত তার ঢেউ বসিরহাট মহকুমাকেও স্পর্শ করেছিল। 1906 সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বসিরহাটে এসেছিলেন রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরীর সঙ্গেই। টাকির জমিদারপুত্র হয়েও তিনি স্বদেশী আন্দোলনে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে থেকে জাতীয় আন্দোলনের ধারাকে পুষ্ট করেছেন।
  • ষষ্ঠীবর লালমাধব উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়টির মূল ভাবনা ছিল রায়চৌধুরী বংশের হরলাল রায়ের। তিনি ছিলেন এলাকার প্রথম গ্র্যাজুয়েট এবং হিন্দুস্কুলের শিক্ষক। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬৩ সাল (মতান্তরে ১৮৬২ সাল)। পরবর্তীকালে ১৮৯৪ সালে স্কুলভবন নির্মাণের জন্য এক হাজার টাকা দেন ষষ্ঠীবর রায়চৌধুরী , এবং ১৯৪৪ সালে স্কুলটাকে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করতে অর্থসাহায্য দেন লালমাধব রায়চৌধুরী এবং এঁদের নামেই এই বালিকা বিদ্যালয়টির নাম হয়। 
  • টাকির রাষ্ট্রীয় জেলা গ্রন্থাগারটিও স্থাপিত হয় ১৯১৮ সালে। ১৯১৭ সালে রামনবমীর দিন (বাংলায় ২৮ শে চৈত্র) টাকি সাধারণ পুস্তকালয় ও পাঠাগার নামে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয় । পরে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী রায় হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর পরলোকগত পুত্রের স্মরণে এটি 'হীরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার' নামে পরিচিত হয় । ১৯৩৪ সালে হরেন রায়চৌধুরীই বাড়িটি গ্রন্থাগারকে দান করেন , যে জমির ওপর গ্রন্থাগারটি বর্তমানে দাঁড়িয়ে সেটিও তিনিই দান করেন । ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটি গ্রহণ করেন এবং ওই বছরই এই প্রতিষ্ঠানটিকে government central library হিসাবে গড়ে তোলেন , উদ্দেশ্য অবশ্যই জেলার দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলগুলিতে সামাজিক শিক্ষাসংক্রান্ত কাজকর্মের প্রসার ঘটানো। 
  • টাকির আদি বাসিন্দা পরমাণু বিজ্ঞানী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশিস দত্ত, প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর রায়চৌধুরী, ভারত সরকারের জেনারেল অ্যাটর্নি ছিলেন স্যর অশোককুমার রায় প্রমুখ।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

টাকির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে যেটা দেখলাম ইন্টারনেটে অনেক জায়গাতেই টাকির ইতিহাস লেখা আছে, কিন্তু সবই খাপছাড়া এবং অনেক জায়গাতেই ভুলে ভরা। ইউটিউবের ট্রাভেল ভ্লগগুলো আরোই অকাজের, সেগুলো দেখে ঘুরতে যাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাসের ছিটেফোঁটা পাওয়া খুব মুশকিল। সমস্যা আরো বাড়ে যখন এই বনেদী বাড়ির লোকজনও ভুল ইতিহাস বলে থাকেন। আগে শ্রীরামপুর নিয়ে লিখতে গিয়েও এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। স্থানীয় মানুষজন অনেক সময় এই সব ভুল শুধরে দিয়েছেন, কখনো তাঁরাও সময়-কাল গুলিয়ে ফেলে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ইতিহাসের গল্প শুনিয়েছেন। ফলে বই বা প্রবন্ধই সহায়। তবে ইদানীং কালে ফেসবুকের কল্যাণে কিছু কিছু গ্রুপে অনেকেই স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে লিখছেন। এই সব মিলিয়েই আমার এই সংকলন। 

বসিরহাট মহকুমার ইতিকথা - পান্নালাল মল্লিক 

https://www.bifocalism.com/historical-and-memorable-festival-of-taki-durgapuja/

https://www.facebook.com/Shahartakiritihas/

বাংলার রাজবাড়ির ইতিহাস - সঞ্চিতা পাল

No comments: